গ্রেফতারের পরে অভিযুক্ত সঞ্জয় অগ্রবাল। শুক্রবার, বিধাননগরে।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সল্টলেকে প্রৌঢ় হত্যার কিনারা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করল বিধাননগর পুলিশ। ওই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে নিহত ব্যক্তির ভাড়াটে, আটত্রিশ বছরের সঞ্জয় অগ্রবালকে। বৃহস্পতিবার নিজের বাড়িতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বিডি ব্লকের বাসিন্দা, অভিজিৎ নাগচৌধুরী (৫৭) নামে ওই প্রৌঢ়কে।
দেহের বিভিন্ন অংশে আঘাতের ধরন দেখে পুলিশের অনুমান ছিল, খুনি পেশাদার দুষ্কৃতী নয়। আক্রোশের বশেই এই খুন করা হয়েছে। সন্দেহ হওয়ায় আটক করা হয় সঞ্জয়কে। জেরার মুখে তিনি ভেঙে পড়েন বলে দাবি পুলিশের।
পুলিশ সূত্রের খবর, বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী সঞ্জয় সল্টলেকের সিএফ ব্লকের বাসিন্দা। তাঁর অফিস এজরা স্ট্রিটে। পাশাপাশি, অভিজিৎবাবুর গ্যারাজেও অফিস করেছিলেন তিনি। তদন্তে জানা গিয়েছে, অভিজিৎবাবুর থেকে ৪২ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন সঞ্জয়। সেই টাকা শোধ করা নিয়েই তাঁর সঙ্গে বিরোধ বাধে অভিজিৎবাবুর। সেই গোলমাল চরমে ওঠে। পুলিশের কাছে সঞ্জয় দাবি করেছেন, দিন পাঁচেক আগে ফের ওই টাকা নিয়ে গোলমাল হলে সঞ্জয়কে অস্ত্র নিয়ে মারতে যান অভিজিৎবাবু। তার পরে গ্যারাজে তালা লাগিয়ে দেন বলেও অভিযোগ।
সেই রাগ থেকেই বুধবার অভিজিৎবাবুকে হত্যার ছক কষেন সঞ্জয়। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই দিন দুপুর থেকে অভিজিৎবাবু বাড়িতে একাই থাকবেন। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে অভিজিৎবাবুর বাড়িতে ঢোকেন তিনি। হাতে কাটারি জাতীয় অস্ত্র ও ব্লেড। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে উপরে উঠে সঞ্জয় দেখেন, কোল্যাপসিবল গেট বন্ধ।
এমন সময়ে বাড়ি ঢোকেন অভিজিৎবাবু। তাঁকে দেখেই মারতে শুরু করেন সঞ্জয়। দু’জনের ধস্তাধস্তি হতে থাকে। তখনই অভিজিৎবাবুর মাথায় কাটারির কোপ মারেন সঞ্জয়। সিঁড়িতেই পড়ে যান তিনি। এর পরে ব্লেড এবং কাটারি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন সঞ্জয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে কেটে দেন গলার নলি। আঘাত করেন যৌনাঙ্গেও। এর পরে মৃত অভিজিৎবাবুর পকেট থেকে চাবি, আংটি ও অন্য গয়না নিয়ে দোতলায় ওঠেন সঞ্জয়। ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র এলোমেলো করে দেন। ফ্রিজ খুলে রাখেন। এ সব মূলত তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য।
কিন্তু সঞ্জয়কে কেন সন্দেহ হল তদন্তকারীদের? এক পুলিশকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় অভিযুক্ত সঞ্জয়ই ওই প্রৌঢ়ের পরিবারকে প্রথম খবর দেন যে, অভিজিৎবাবুর সাড়া মিলছে না। তাঁকে ওই বাড়িতে অপেক্ষা করতে বলা হলে তিনি জানান, কাজে বাইরে যাচ্ছেন।
তদন্ত: জিজ্ঞাসাবাদের পরে থানা থেকে বেরোচ্ছেন নিহত অভিজিৎবাবুর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে।
পুলিশ গিয়েও তাঁর দেখা পায়নি। তখনই প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ হয়। তদন্তকারীদের ডাকে ওই দিন রাতে সঞ্জয় পুলিশের কাছে যান। তত ক্ষণে অভিজিৎবাবুর পরিবারের লোকজন এবং এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে গিয়েছে পুলিশের। তাঁদের কাছ থেকেই সঞ্জয়ের বিষয়ে জানতে পারে পুলিশ। অভিজিৎবাবু ও সঞ্জয়ের গোলমালের কথা শোনা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকেও। সঞ্জয়ের মোবাইল ঘেঁটে পুলিশ দেখে, কললিস্ট থেকে বহু তথ্য ডিলিট করে দিয়েছেন।
এর পরে লাগাতার জেরার মুখে ভেঙে পড়েন সঞ্জয়। তবে পুলিশের দাবি, সঞ্জয় জানিয়েছেন, টাকার জন্য নয়, অপমানের প্রতিশোধ নিতেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। সঞ্জয়ের সেই বক্তব্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শুক্রবার অভিজিৎবাবুর গ্যারাজের ঘরে পরীক্ষা চালান ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। সেখানেও রক্তের দাগ মেলে। দোতলার ঘরে বৃহস্পতিবার রাতেই মিলেছিল হাতের ছাপ। তদন্তে জানা গিয়েছে, অভিজিৎবাবু শৌখিন মানুষ ছিলেন। দামি পোশাক পরতেন। পার্টিতে যেতেন। ছোটখাটো কারণে মাথাও গরম করতেন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর ১৫ আগে অভিজিৎবাবু ও তাঁর স্ত্রী আলাদা থাকতে শুরু করেন। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী শ্যামপুকুরে থাকেন। বিবাহিতা অপর মেয়ে থাকেন বিধাননগরেই। অভিজিৎবাবুর এক বান্ধবীর কথাও জেনেছে পুলিশ। কথাও বলেছে তাঁর সঙ্গে।
বিধাননগর পুলিশের এক কর্তা জানান, এই ঘটনার নেপথ্যে অন্য কোনও রহস্য রয়েছে কি না, কিংবা আরও কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
—নিজস্ব চিত্র।