চলমান: শহরের পথে এ ভাবেই পথ চলা।
‘বাড়িতে কেউ আছেন?’
দোতলার জানলা থেকে সতর্ক মুখ জিজ্ঞাসা করে, ‘কী চাই?’
কাঁধের ঢাউস ব্যাগ থেকে সাবধানে রংচঙে প্যাকেটটা বের করেন তরুণী। ‘দিদি, এই বিস্কুটটা বাজারে কিনতে গেলে ৪০ টাকা। আমরা শুধু আজকের জন্য ২৫ টাকায় দিচ্ছি।’ —প্রত্যুত্তর প্রত্যাশিতই, ‘লাগবে না।’
হঠাৎ মায়ের পাশ থেকে ছোট্ট মুখের উঁকিঝুঁকি। ‘মা, ওই বিস্কুটটা ভাল খেতে, একটা নাও না।’ টান মেরে মেয়েকে সরিয়ে নেন সাবধানী মা। বিস্কুটের প্যাকেট ব্যাগে ভরতে ভরতে কানে আসে, ‘কত বার বলেছি না, ওরা দুষ্টু লোক। বাড়িতে কে আছে তার খবর নিতে আসে। তার পর চোর-ডাকাতদের খবর দিয়ে দেয়।’
কান দুটো লাল হয়ে যায় স্বপ্নার। সূর্য তখন মাঝ আকাশে আগুন ছড়াচ্ছে। ঢকঢক করে গলায় ঢালা জলটাও তেতো লাগে। ব্যাগে এখনও অনেকগুলো প্যাকেট। আরও অন্তত ১০টা না বেচলে আজকের ‘টার্গেট’ পূরণ হবে না। অগত্যা অপমান হজম করে পাশের দরজায় ঠকঠক।
বাড়ির প্রবেশপথে থাকে নিষেধাজ্ঞা।
‘‘সোজা কথায় একটা প্যাকেটও বেচতে পারবি না। একটু কায়দা করে সার্ভে বলে ডেকে আনতে হবে। আমি শিখিয়ে দেব।’’— রুটির টুকরো মুখে চালান করতে করতে স্বপ্নাকে বললেন নীলিমাদি। মানিকতলার অখ্যাত রকের এক চিলতে ছায়ায় তখন গোল করে বসে ওরা সাত জন। পাঁচটা স্টিলের টিফিনকৌটোর রুটি-তরকারি ভাগাভাগি হয়ে ভরে যায় সাতটা পেট।
এমন ভাবে দরজায় দরজায় ঘুরে যথেষ্ট বিক্রি হয়?
আগন্তুকের অযাচিত কৌতূহলে টিফিনকৌটোর ঢাকনা আধো বন্ধ হয়। কিন্তু লুকিয়ে ফেলেন না। ওঁদের সন্দেহ বড় কম। সরে বসে আগন্তুককে জায়গা করে দেন। বছর চল্লিশের এক যুবক বলেন, ‘‘জিনিসটা দেখাতে পারলে তবে তো বিক্রি। আজকাল বেশির ভাগ লোকজন আমাদের অবিশ্বাস করেন। চোর-ডাকাতের ইনফর্মার ভেবে দরজা খুলতেই চান না। কেউ কেউ তো জানলা থেকেই খেদিয়ে দেন।’’
উচ্ছ্বল হেসে পিয়ালী বলেন, ‘‘মেয়েদের দেখলে তবুও কেউ কেউ বন্ধ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে জিনিসটা এক বার হাতে নিয়ে দেখেন। আমাদের কাজে ছেলেদের হাল বেশি খারাপ।’’
তা হলে বিক্রি করেন কী করে? নীলিমা বলেন, ‘‘প্রথমেই বিক্রির কথা বলি না। বলি সাবান, বিস্কুট, পাউডার, টুথপেস্ট বা অন্য কোনও ‘প্রোডাক্ট সার্ভে’ করতে এসেছি। জানলা থেকে কথা বললেও চলবে। তাতে অনেকে আশ্বস্ত হয়ে কথা শুরু করেন। কথায় কথায় খরিদ্দারের বিশ্বাস জিততে হয়। তার পরে ব্যাগের জিনিস বার করে বলি কী অফার আছে। দশ জনের চার জনও যদি কেনেন, সে-ও অনেক।’’
এই রোজগারে সংসার চলে? ওঁরা জানালেন, মাইনে খুব বেশি না। তবে দিনের টার্গেটের থেকে বেশি প্যাকেট বিক্রি হলে তার উপরে ‘ইনসেন্টিভ’ মেলে। স্বপ্না বলেন, ‘‘এখন যেখানে ভাড়া থাকি, সেই বাড়িতে অনেক ঘর ভাড়াটে। সারা দিন চিৎকার, ঝগড়া। স্বামীর উপার্জনে সংসার চলে যায়। আমার রোজগারের টাকা জমিয়ে রাখি। ওই টাকা দিয়ে এক কামরার ঘর কিনব। নিজেদের উঠোনও থাকবে।’’
কথা বলতে বলতেই টিফিনকৌটোগুলো কখন চালান হয়ে গিয়েছে যার যার ব্যাগে। উসখুস করা মুখগুলোয় স্পষ্ট, এ বার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ছেলেমেয়ে, বয়স্ক বাবা-মা, পরিজনের কাছে ফেরার তাড়া। কথাটা বলতেই আর এক দফা হাসি। ‘‘বাড়ি ফিরতে ঢের দেরি। এই এলাকা হয়ে গেল, এখন যাব এন্টালি।’’
ভারী ব্যাগ কাঁধে দলটা ভাগ হয়ে হারিয়ে যায় মহানগরের অন্য পিন কোডে। আর কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট পেরিয়েই হয়তো এক চিলতে উঠোনের ঠিকানা।
কেয়ার অব কলকাতা।
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।