ডাঁই করে পরপর রাখা বস্তা। পাশেই পড়ে লোহার রড, ভাঙা চেয়ারের টুকরো। কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ এবং নানা নির্মাণ সামগ্রীও এমন ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যে, সে সব সরিয়ে সিঁড়ি ধরে এগোনোর পথই নেই! কসবার অ্যাক্রোপলিস মলে শুক্রবার দুপুরে আগুন লাগার পরে লিফ্ট বন্ধ দেখে সিঁড়ি দিয়ে পড়িমরি করে নীচে নামার মুখে এমনই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন সেখানে উপস্থিত লোকজন। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘সিঁড়ির এমনই হাল ছিল যে, নামার জায়গাই প্রায় ছিল না। অনেকেই হাতে হাতে বস্তা তুলে একটির উপরে আর একটি রেখে এগিয়েছেন। হুড়োহুড়ির মধ্যে লোহার ঘায়ে আহতও হয়েছেন কেউ কেউ।’’ তাঁদের প্রশ্ন, এমন জরুরি সময়ে মূল ব্যবহার্য সিঁড়ির যে এই অবস্থা হয়ে রয়েছে, সেটা কি জানতেন না মল কর্তৃপক্ষ?
সারা দিনেও এ নিয়ে অ্যাক্রোপলিস মল কর্তৃপক্ষের কোনও সদুত্তর মেলেনি। বরং ওই শপিং মল অগ্নি-নির্বাপণে কতটা প্রস্তুত, তাঁদের পক্ষ থেকে সেই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মল কর্তৃপক্ষের তরফে ইঞ্জিনিয়ার মুকুন্দলাল রায় বলেন, ‘‘পাঁচটি সিঁড়ি আছে। যে কোনওটি ব্যবহার করা যেত। সিঁড়িতে কিছু ফেলে রাখা হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হবে।’’
অতীতে একাধিক অগ্নিকাণ্ডে বিপদের সময়ে সিঁড়ি ব্যবহার করতে না পারায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে শহরে। তার পরেও শহরের একটি ব্যস্ত শপিং মলে এই পরিস্থিতি থাকে কী করে? ঘটনাস্থলে উপস্থিত দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই খোঁজ নেব। যদি কারও গাফিলতি থাকে, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ একই সুরে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, ‘‘ওই রকম সময়ে সিঁড়ি ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যা হওয়াটা মারাত্মক ব্যাপার। কেন এমন হয়েছে, পুলিশ নিশ্চয়ই দেখবে।’’ লালবাজারের তরফে যদিও এ নিয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া মেলেনি। দমকলের তরফে অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্তের মধ্যে আনা হবে বলে জানান এক পুলিশকর্তা।
একুশতলা উঁচু মলের ষোলোতলায় একটি সিমেন্ট সংস্থার অফিসে কাজ করেন অপু দাস। তিনি ঘটনার সময়ে অফিসেই ছিলেন। বাইরে বেরোনো কিছু সহকর্মী তাঁকে ফোন করে মলের ফুড কোর্টে আগুন লাগার খবর জানান। দ্রুত বেরিয়ে আসতে গিয়ে অপু সিঁড়িতে প্রবল সমস্যায় পড়েন। তাঁর কথায়, ‘‘শয়ে শয়ে মানুষ তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। দেখি, সিঁড়ি জুড়ে লোহা, ছাঁট লোহা, রাবিশ ভরা বস্তা পড়ে। নামতে গিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। চারতলায় নেমে দেখি, চার দিকে কালো ধোঁয়া। অনেকেরই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দুই সহকর্মী, দীপঙ্কর প্রামাণিক ও শ্রাবণী সর্দার অসুস্থ হয়ে পড়েন।’’ সম্প্রতি বাইক দুর্ঘটনায় আঘাত লাগায় দীপঙ্করের পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। অপু বলেন, ‘‘ওই সরু সিঁড়ি দিয়ে ওদের নামাতে খুব সমস্যা হয়েছে।’’ হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়া আর এক জনের মন্তব্য, ‘‘১২ ফুটের সিঁড়ির চার ফুট শুধু যাতায়াতের জন্য খোলা ছিল। তার মধ্যে এত লোকের একসঙ্গে নামার তাড়া। পদপিষ্ট হয়েই অনেকের মৃত্যু হতে পারত।’’
ওই সিঁড়ি দিয়েই কোনও মতে নামানোর চেষ্টা হয়েছে মমতা সাউ নামে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে। ভিড়ের মধ্যে তাঁকে বসানো হয় এক জায়গায়। বস্তা সরিয়ে সরিয়ে এগোনোর চেষ্টা করেন সহযোগীরা। কিন্তু পরে তাঁর জন্য স্ট্রেচার আনাতে হয়। তত ক্ষণে দমকলকর্মীরা এসে ওই সিঁড়ি দিয়েই উপরে ওঠার চেষ্টা শুরু করেন। মহম্মদ রহিম নামে মলেরই এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘এক দিকে মানুষ বাঁচার জন্য সিঁড়ি দিয়ে ছুটছে। অন্য দিকে দমকল সেই সিঁড়ি দিয়েই বাঁচানোর জন্য উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। এমন দৃশ্য দেখিনি। এই মলের সিঁড়িই হতে পারত মৃত্যুফাঁদ!’’