বাতিস্তম্ভে খোলা তার। সোমবার, নিউ মার্কেটে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বর্ষা এলেই অবধারিত ভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে শহরে। মৃত্যুর কারণ জানা যায়, কিন্তু কার গাফিলতিতে সেই মৃত্যু হল, তা কখনওই সামনে আসে না বলে অভিযোগ। কড়া শাস্তি হওয়ার নিদর্শন তো নেই-ই, কিছু দিন দায় ঠেলাঠেলি চলে প্রশাসনিক স্তরে। তার পরে আবার যে কে সে-ই! পুলিশেরই হিসাবে, গত পাঁচ বছরে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বৃষ্টির মধ্যে পথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। যার মধ্যে সব চেয়ে বেশি শোরগোল পড়েছিল গত বছর হরিদেবপুরে এবং তার আগের বছর রাজভবনের কাছে বাতিস্তম্ভের খোলা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায়। কিন্তু তাতেও কি পরিস্থিতি বদলেছে? নাগরিকদের অভিজ্ঞতা, চলতি বছরেও বর্ষার মুখে শহরের বিপদ বাতিস্তম্ভের সেই খোলা তারই!
দেখা যাচ্ছে, তিলজলা, ট্যাংরা, তপসিয়া, রবীন্দ্র সরণি, মানিকতলা রোড, ক্যানাল ইস্ট রোড, আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা সংলগ্ন রাস্তার পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন অলিগলিতেও রয়েছে বাতিস্তম্ভের খোলা তার। কোথাও বিপজ্জনক ভাবে খোলা রয়েছে ঢাকনা, কোথাও বাতিস্তম্ভে ঢাকনাই নেই। কসবা, যাদবপুর, ভবানীপুর, টালিগঞ্জ-সহ বেশ কিছু এলাকায় আবার বাতিস্তম্ভের খোলা অংশে প্লাস্টিক বা কালো টেপ জড়িয়ে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। হেস্টিংস এলাকার একটি রাস্তায় আবার দেখা গেল, এমন বেরিয়ে থাকা তারের কাছেই ভেজা পোশাক মেলে রেখেছেন সেখানকার ফুটপাতবাসীরা। বেলেঘাটায় দেখা গেল, খুলে বেরিয়ে এসেছে পুরসভার লাগিয়ে দেওয়া টেপ। ওই টেপের সঙ্গেই ঝুলছে তারের জট। এমন বিপজ্জনক বাতিস্তম্ভ সব চেয়ে বেশি চোখে পড়ছে শহরের বস্তি এলাকাগুলিতে। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি উন্নয়ন) স্বপন সমাদ্দার সোমবার বললেন, ‘‘শহরে নথিভুক্ত, অনথিভুক্ত মিলিয়ে প্রায় ৩৩৩৪টি বস্তি রয়েছে। গত বছরই পুরসভার বস্তি উন্নয়ন বিভাগের তরফে প্রতিটি বস্তির জন্য এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বাতিস্তম্ভে নজরদারি করতে বলার পাশাপাশি ফাইবার দিয়ে মুড়ে ফেলতেও বলা হয়েছে। তার পরেও গাফিলতি হলে পুরসভার আলো বিভাগ বলতে পারবে।’’
গত বছরই হরিদেবপুরে খেলতে খেলতে জমা জলে বিদ্যুতের সংস্পর্শে এসে নিশীথ যাদব নামে এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় এমনই দায় ঠেলাঠেলি সামনে আসে। জানা যায়, জমা জলে ওই কিশোর যেখানে পড়ে গিয়েছিল, তার পাশেই ছিল বিএসএনএলের একটি টেলিফোনের স্তম্ভ। তাতে আলো ঝুলিয়েছিল পুরসভা। বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ বলে দেন, টেলিফোনের স্তম্ভ ছুঁলে মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। তবে, ওই খুঁটিতে তাঁদের অনুমতি না নিয়েই বিদ্যুতের সংযোগ টানা হয়েছিল। স্থানীয় ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি দাবি করেন, জায়গাটা অন্ধকার ছিল বলে টেলিফোনের ওই স্তম্ভে পুরসভা অস্থায়ী ভাবে আলো লাগিয়েছিল। মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ অবশ্য সেই সময়ে সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দেন, পুরসভার নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থেই ওই স্তম্ভে আলো লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও কার গাফিলতিতে সেই ঘটনা, তা জানা যায়নি। একই ব্যাপার হয়েছিল রাজভবনের সামনে জমা জলে ঋষভ মণ্ডল নামে এক যুবকের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায়। সেখানে পুরসভার একটি খুঁটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ টানা হয়েছিল। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে পুরসভা ও সিইএসসি-র কাছে জবাব তলব করে। কিন্তু দু’বছর পরেও রহস্য কাটেনি।
মেয়র পারিষদ (আলো) সন্দীপরঞ্জন বক্সী এ দিন বললেন, ‘‘ওই সমস্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই এ বছর বর্ষার শুরুতে গাড়ি করে প্রতিটি পুরসভায় প্রচার চালানো হয়েছে। সেই সঙ্গে জল জমলেই শহরের প্রায় দেড় লক্ষ ত্রিফলা আলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, পুরসভার প্রায় তিন লক্ষ খুঁটি রয়েছে। সেগুলির আর্থিং ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখে নিতে গত বছর প্রতিটি পুরসভায় আর্থ-মেজ়ার যন্ত্র কেনা হয়েছিল। ওই যন্ত্রগুলিও এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পরেও খুঁটিতে বিপজ্জনক কিছু চোখে পড়লে দ্রুত পদক্ষেপ করতে বলেছি। যেখানে যা সমস্যা রয়েছে, সবটা দ্রুত দেখে নেওয়া হচ্ছে।’’ কিন্তু ‘আর্থ মেজ়ার’ যন্ত্রের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, ব্যবহার করা তো দূর, বহু পুরসভায় এই যন্ত্রের খোঁজই নেই। গত বছর কেনা হলেও এখন সে সেব কোথায়, বলতে পারলেন না একাধিক পুরপ্রতিনিধিই।