অবশেষে ডিসেম্বরের শেষ লগ্নে এসে ১৪ ডিগ্রির নীচে নামল কলকাতার পারদ! আলিপুর হাওয়া অফিসের খবর, বুধবার মহানগরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এ সময়ে স্বাভাবিক। যদিও শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে থাকাটাই দস্তুর।
ক্যালেন্ডারে পৌষের প্রায় মাঝামাঝি হতে চলল। কিন্তু কলকাতায় শীতের দেখা নেই কেন? আবহাওয়া দফতর সূত্রে বারবারই নিম্নচাপ, ঘূর্ণাবর্ত ও দুর্বল উত্তুরে হাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশবিদেরা বলছেন, শুধু এগুলিকে দুষলেই হবে না। ভরা ডিসেম্বরেও শীত না মেলার পিছনে মহানগরীর মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণ যারপরনাই দায়ী। তাঁরা বলছেন, মাত্রাছাড়া বায়ুদূষণের ফলেই মহানগরীর পারদ নামতে বাধা পাচ্ছে। দূষণের মাত্রা কম থাকায় গ্রামাঞ্চলে শীতের অনুভূতি বেশি। পরিবেশবিদদের সতর্কবার্তা, এই দূষণ যত বা়ড়বে, ততই কলকাতা থেকে উধাও হবে শীত।
শুধু তা-ই নয়, ভোরের দিকে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় যে প্রবল ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে তার পিছনেও দূষণকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা। সেই ধোঁয়াশা কেমন তা হাড়েহাড়ে মালুম পেয়েছিলেন মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা এক শিক্ষিকা। ভোরবেলায় মাকে নিয়ে সল্টলেকে চক্ষু হাসপাতালে যাচ্ছিলেন তিনি। ওই শিক্ষিকার অভিজ্ঞতা, ‘‘যশোর রো়ড এবং নিউ টাউনের রাস্তায় কয়েক হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, চারপাশ যেন মোটা চাদর দিয়ে কেউ ঢেকে রেখেছে!’’ চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা, এই দূষণ স্বাস্থ্যের পক্ষেও মারাত্মক।
কলকাতার দূষণের ছবিটা কী, তা স্পষ্ট হয় মার্কিন দূতাবাসের তথ্য দেখলেই। তাদের কাছ থেকে পাওয়া বায়ুদূষণ সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মঙ্গলবার রাত বারোটায় কলকাতার বায়ুদূষণের সূচক ছিল ২৩৯। অর্থাৎ, ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। বুধবার বিকেল তিনটেয় সূচক ছিল ১৯০। এক পরিবেশবিদ বলছেন, ‘‘সূচক ২০০-র ঘর ছুঁলে ভীষণ অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। কিন্তু ১৯০-ও খুব খারাপই বলা চলে।’’ পরিবেশবিদদের অভিযোগ, ডিজেলচালিত গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলোতে রাশ না টানার ফলেই এই দূষণ বাড়ছে।
কী ভাবে এই দূষণ শীতের পথে বাধা তৈরি করছে? পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দীচক্রবর্তী বলছেন, বাতাসে কার্বন কণা ও ধুলোর জন্য মাটি থেকে তাপ পুরোপুরি বিকিরত হতে পারছে না। এর পাশাপাশি কার্বন কণার তাপশোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তা তাপ শুষে নিচ্ছে। ফলে বাতাসে গরম ভাব থাকছে। তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে শীতের অনুভূতিও কম হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে দূষণ তুলনায় কম হওয়ায় সেখানে শীতের অনুভূতি বেশি হয়।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত মিদ্যা বলছেন, বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বা়ড়লে তা তাপ বিকিরিত হতে দেয় না। একটা চাদরের মতো আবরণ তৈরি করে ভিতরের পরিবেশকে গরম করে তোলে। যেটিকে ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’ বলা হয়। একই সুর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের প্রধান তড়িৎ রায়চৌধুরীর গলাতেও। তিনি বলছেন, বায়ুতে বাড়তি কার্বনের জেরেই তো গোটা বিশ্ব উষ্ণ হয়ে উঠছে। কলকাতার ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা নজরে আসছে। এটা চলতে থাকলে জলবায়ু বদলে যাবে।
হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, পরপর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্তের জেরে বাতাসে জলীয় বাষ্প ঢুকেছে। রাতে তাপমাত্রা কমলে তা কুয়াশা তৈরি করে। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, রোদ উঠতে শুরু করলেই কুয়াশা কেটে যায়। ইদানীং শহরে যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, তা ঠিক সাদা নয় বরং কালচে রঙের। চট করে তা কাটছেও না। স্বাতীদেবী জানান, বাতাসে কার্বন ও ধূলিকণা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে তাকে গাঢ় করে তুলছে। ক্রমাগত তাপ শুষতে থাকায় রোদ উঠলেও তাই জমাট বাধা জলীয় বাষ্প সহজে কাটছে না।