প্রতীকী ছবি।
একই বাড়িতে গাদাগাদি করে প্রায় ১০০ জন গর্ভবতী মহিলার বাস! কারণ, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের ওই মহিলারাই সংসারের হাল ধরতে গর্ভাশয় ভাড়া দিয়েছেন। বিজ্ঞান যাঁদের বলছে ‘গর্ভদাত্রী মা’। এঁদের আয়ের থেকে সদ্যোজাত-পিছু প্রায় চার গুণ বেশি টাকা নিয়ে ব্যবসা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল গুজরাতের আনন্দ জেলার এক মহিলা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। দেশে শিশু তৈরির এমন একাধিক কারখানার খবর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে বেরোনোর পরেই হইচই শুরু হয়। সরকার বাধ্য হয় গর্ভ ভাড়া পদ্ধতিকে নিয়মে বাঁধার কথা ভাবতে। যার ফল ‘দি অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি অ্যান্ড সারোগেসি অ্যাক্ট, ২০২১’। গত ২৫ জানুয়ারি এই আইন বলবৎ হয়েছে।
বলিউডের তারকা শাহরুখ-আমির, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া জোনাসের দৌলতে ‘গর্ভ ভাড়া’ এখন আর অচেনা শব্দ নয়। ফলে বিভিন্ন মহলে এই নতুন আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারণ এই আইন বলছে, রূপান্তরকামী ও সমকামী দম্পতি, একা থাকা পুরুষ বা অবিবাহিত মহিলারা এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে সন্তানের জৈবিক বাবা বা মা হতে পারবেন না। এই আইন সমর্থন করে শুধুই ‘অলট্রুয়িস্টিক সারোগেসি’-কে (সেবার মনোভাব নিয়ে যিনি গর্ভে অন্যের সন্তান ধারণ করেন)। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব? তবে কি আটকে যাবে মেডিক্যাল সারোগেসিও (চিকিৎসাশাস্ত্রে যখন কোনও নারী সন্তান ধারণে অপারগ)?
তা হলে কি সোশ্যাল সারোগেসি আদৌ সমর্থনযোগ্য? এ নিয়ে ‘আরও আনন্দ’ আয়োজিত এক আলোচনায় ছিলেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সুদীপ বসু, মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল এবং সারোগেসির মাধ্যমে যমজ সন্তানের বাবা হওয়া, একক অভিভাবক অভিষেক পাল। আজ, শুক্রবারই মুক্তি পাচ্ছে সারোগেসি নিয়ে বাংলা ছবি ‘বাবা, বেবি ও...’। সেখানেও উঠে এসেছে গর্ভ ভাড়ার নানা দিক। ছবির মুখ্য অভিনেতা যিশু সেনগুপ্ত, অভিনেত্রী রেশমি সেন, কাহিনিকার জিনিয়া সেনও ছিলেন ওই আলোচনায়।
সম্পদ যখন সীমিত, তখন বুঝেশুনে তার ব্যবহারেরই পক্ষে চিকিৎসক সুদীপ বসু। তাঁর কথায়, “সোশ্যাল সারোগেসি সেই অর্থে মেডিক্যাল সারোগেসির অন্তরায় নয়। তবে গর্ভদাত্রী মা যে হেতু প্রয়োজনের তুলনায় কম, তাই কাদের জন্য এই ব্যবস্থা জরুরি, সেটায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।” পাশাপাশি এ কথাও উঠে এল, এই আইন রূপান্তরকামীদের অবশ্যই বঞ্চিত করছে। সুদীপবাবুর প্রশ্ন, যাঁদের সামাজিক স্বীকৃতি দিচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, তাঁদের সন্তানপ্রাপ্তিতে কী ভাবে বাধা হতে পারে আইন? একক কোনও অভিভাবক বাবা-মায়ের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হবেন, সেটাই বা কেন ধরে নিচ্ছেন আইনপ্রণেতারা? বাস্তবে বলিউডের করণ জোহর বা তুষার কপূরের মতো এই ছবিতে একক অভিভাবকের চরিত্রে রয়েছেন যিশু। তাঁর প্রশ্ন, পুরুষেরা তাঁদের স্ত্রীর অবর্তমানে সন্তান প্রতিপালনে কি ব্যর্থ হন? তিনি বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের এই পদ্ধতিকে সমাজের প্রয়োজনে কাজে লাগানো হোক। ছবির শেষে সুন্দর বার্তা থাকছে, সমাজ থেকে উঠে আসা যাবতীয় প্রশ্নে দাঁড়ি টেনে শিশুরা কী ভাবে সংসারকে খুশিতে ভরিয়ে তুলতে পারে।”
২০১৩ সালে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন অভিষেক। পরের ছ’বছরে আর দ্বিতীয় বিয়ের তাগিদ অনুভব করেননি বটে, তবে বাবা ডাক শোনার আর্তি ছিল তাঁর। অবশেষে গর্ভ ভাড়ার মাধ্যমে দিল্লিতে জন্মানো যমজ সন্তানের বাবা হন। বছর দুয়েক আগে লকডাউনে আটকে থাকার পরে, যে দিন প্রথম ওদের প্রায় দু’মাস বয়সে কোলে নিয়েছিলেন, সে দিন থেকে খুশিতে ভরে ওঠে অভিষেকের ঘর।
এই ঘটনার সঙ্গে মিলে যায় জিনিয়ার দাদার জীবন। সে সবই ছবির কাহিনিতে তুলে ধরেছেন তিনি। শুটিং-পর্বে কড়া ভাবেই কোভিড-বিধি মানা হয়েছে বলে জানালেন কলাকুশলীরা। যার মূল কারণ ছিল সাত এবং আট মাসের দুই শিশু।
গর্ভ ভাড়ার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের বড় করার পথে কোনও মানসিক চাপ তৈরি হলে কী ভাবে সামলাবেন অভিভাবক? মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল বলেন, “শিশুর বিশেষ প্রক্রিয়ায় জন্মের কথা তার বয়ঃসন্ধি কালেই ধীরে ধীরে জানিয়ে দেওয়া হোক। নয়তো বড় বয়সে সে কথা জানলে মানসিক কষ্ট তৈরি হতে পারে।” তাঁর প্রশ্ন, গর্ভদাত্রী মা ও শিশুটির মা-বাবার মানসিক যত্ন এবং কাউন্সেলিংয়ের কথা এই সারোগেট আইনের কোথাও কি বলা আছে? সেটাও এ ক্ষেত্রে জরুরি।