স্মৃতি: টালা সেতুতে সত্যজিতের ‘অপু’।
টালা সেতু থেকে নামার মুখে টহলদার পুলিশের খপ্পরে পড়েছিলেন তিনি। ধুতি-বাংলা শার্টের উস্কোখুস্কো বঙ্গযুবার কাটা-কাটা উচ্চারণে দৃপ্ত আবৃত্তির মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেননি পাহারাওয়ালা। উটকো মাতাল ভেবে হিন্দিভাষী পুলিশটি চেঁচিয়ে ওঠেন ‘‘কৌন হ্যায়!’’ শুনে সেতুর সিঁড়িতে বন্ধু পুলুকে নিয়ে সটকে পড়ার আগে ফুরফুরে যুবকের ঠাট্টা, ‘‘আমি হলাম হিমাদ্রি অঙ্গজ মৈনাক পাখার জ্বালায় জলে ডুবে আছি...’’
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসারে’ পরপর ফ্রেমে ‘টালা ব্রিজটাও’ যেন একটা চরিত্র। কলকাতার নাগরিক জঙ্গলে পুরাণের ডানাভাঙা মৈনাক পর্বতের মতো দিশাহারা অপুর ছটফটানি, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ— সব কিছুরই সাক্ষী সেই শহুরে সাঁকো। সত্যজিতের চিত্রনাট্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সেতুর অমোঘ উপস্থিতি। সে দিনের অপু, আজকের মধ্য আশির সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রবিবার বলছিলেন, ‘‘সেই প্রথম সিনেমার শুটিং স্মৃতি তো বটেই, টালা ব্রিজ পেরিয়ে বোধহয় অন্তত ১০০ বার যাতায়াত করেছি।’’ অপুর সংসারের টালা সেতুর চেহারায় বদল এসেছিল ১৯৬৪-র পরে। কাঠের সেতুর তখন কংক্রিট দেহ। অপুর মতো পথচারীরা টালা সেতু থেকে বিদায় না-নিলেও রিকশার বদলে সেখানে ছিল ভারী যানবাহনেরই রমরমা। কিন্তু প্রহরীর মতো উঁচু একটি সেতুর অবস্থান, নীচে চিৎপুরের রেল ইয়ার্ড, মালগাড়ির বাঁশি, শূকর অধ্যুষিত ডোমপাড়া পেরিয়ে মধ্যবিত্ত গেরস্ত কলকাতার চেহারাটা এখনও অনেকটাই অটুট। টালা সেতু ভাঙার পরে তার নবজন্ম ইস্তক ওই তল্লাটের কলকাতার আকাশরেখায় একটা ফাঁক থেকে যাবে।
রাতের টালা সেতুতে অপু আর পুলুর (অভিনেতা স্বপন মুখোপাধ্যায়) হেঁটে যাওয়ার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির শুটিংয়ের খুঁটিনাটি এখন মনে নেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু মনে পড়ে রাতে অনেক ক্ষণ চলেছিল শুটিং। আর একটি দৃশ্যে দুপুর বা বিকেলেও টালা সেতু ধরে হেঁটে যাচ্ছেন সৌমিত্র। সেতু থেকে নেমে স্ত্রী অপর্ণার চিঠি পড়তে পড়তে অপু এগোচ্ছেন পরিপূর্ণ আনন্দে। আবহে রবি শঙ্করের সেতার। তখনও জানেন না, কী চরম দুঃসংবাদ অপেক্ষায়! তাঁর পিছনে টালা সেতু দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো। ‘‘খুব কম ছবিতেই শহরের কোনও দিকচিহ্ন এমন অভিঘাত তৈরি করে।’’— বলছিলেন চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙিনায় বাঙালির অন্যতম সেরা সৃষ্টির সঙ্গেও অবিচ্ছেদ্য যোগ টালা সেতুর।সৌমিত্রর কাছে টালা সেতুর তল্লাট স্মরণীয় তখনকার মানুষজনের জন্যেও। ‘‘অপুর সংসারের পরপরই তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ করি। তপনবাবুও তখন টালা ব্রিজের কাছেই থাকতেন।’’ টালা সেতুর পাশেই টালা ডাকঘরের কাছ থেকে টালা পার্ক, পাইকপাড়া জুড়ে তখন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-নাটকের জ্যোতিষ্কদের সমাবেশ। সৌমিত্রবাবুর মনে পড়ছিল, ‘‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছাড়াও ‘পথের পাঁচালি-অপরাজিত’র হরিহর কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ওখানেই থাকতেন। বিচারপতি মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও এসেছি।’’ টালা ডাকঘরের পিছনে বনমালী চ্যাটার্জি স্ট্রিটে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছেই এখন তাঁর আবক্ষ মূর্তি বসেছে। কানুবাবুর ছোট ছেলে অমৃত বন্দ্যোপাধ্যায় সপরিবার পুরনো বাড়িতেই থাকেন। এর খুব কাছেই বাঙালির রোম্যান্টিকতার একটি সৌধ, অপুর সংসারে অপু-অপর্ণার স্বপ্নের সংসারের বাড়িটি। ঠিকানা, রাজা শিউবক্স বগলা লেনে। ‘‘তিন বছর আগেও বাড়িটা আগের চেহারাতেই ছিল। ওই রকে বসে কত প্রেম করেছি!’’— বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা অভিষেক ভট্টাচার্য। এখন পাড়ার বাড়িগুলির চেহারা পাল্টে গিয়েছে। সেতু থেকে নেমে রেল ইয়ার্ডের নিচু পাঁচিল টপকে সোজা বাড়িতে ঢুকতেন অপু ওরফে সৌমিত্র।
কাছেই টালার চক্ররেল স্টেশন হওয়ার পরে সেই পাঁচিল অনেক উঁচু হয়েছে। ভাঙাভাঙির কাজ শুরুর পরে এখন টালা সেতু জুড়ে যন্ত্রের ছড়াছড়ি। ফুটপাতের পেভার উঠে বেরিয়ে এসেছে অস্থিমজ্জা। এই ছুটির দুপুরে শীতের রোদ মেখে বন্ধ সেতুতে তবু ক্রিকেট চলছে চুটিয়ে। নতুন টালা সেতু তৈরি হলে সম্ভবত একেলে ‘ফ্লাইওভারের’ আদল পাবে। কিন্তু কোনও অপু কি আর কখনও তার উপরে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে যাবে?