অভিযান: কোস্টা রিকায় সবুজ কচ্ছপের ছবি তুলতে প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে ধৃতিমান। এমনই ছবির সম্ভার নিয়ে অভিজ্ঞতার গল্প শোনাবেন তিনি।
লাদাখ হিমালয়ে বিরল দর্শন স্নো-লেপার্ড। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বিপন্ন পাখি নারকোন্ডাম হর্নবিল। ওড়িশায় অলিভ রিডলে কচ্ছপ। ব্রাজিলের নদীতে ১৫ ফুট লম্বা সবুজ অ্যানাকন্ডা। কঙ্গোর জঙ্গলে গোরিলা। শীতে জমে যাওয়া বৈকাল হ্রদে নেরপা সিল। মেক্সিকোর উপকূলে হোয়েল শার্ক। ক্যারিবিয়ান সাগরে আমেরিকান কুমির। আন্টার্কটিকায় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র...।
দেশে-বিদেশে এমন হাজারো বন্যপ্রাণী এবং বিপন্ন প্রজাতিকে ফ্রেমবন্দি করার নেশায় তিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই কাটান সভ্য সমাজ থেকে দূরে, জঙ্গল-পাহাড়-মেরু অঞ্চলে। নেহাত প্রতিযোগিতা নয়, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজে সাহায্য করতেই ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়ান এই বাঙালি ছবিওয়ালা— বছর চুয়াল্লিশের ধৃতিমান মুখোপাধ্যায়। এ বার সেই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত বিষয় নিয়ে কলকাতাবাসীকে সচেতন করতে নিজের তোলা ছবির সম্ভার নিয়ে শহরে ফিরছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যাদের জন্য বলার লোক নেই, তাদের কথা ভাববার লোক তৈরি করে দিতেই আমার ছবি দেখানো ও গল্প বলা। এ ভাবেই ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন পরিবেশগত বিষয় নিয়ে জনমত তৈরি করা কিন্তু সম্ভব।’’
ছোটবেলায় জীবনবিজ্ঞান থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে চাওয়া, বারাসতের ধৃতিমান এখন বাস্তুতন্ত্রের ছবি তুলতে ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর আনাচকানাচে। গত ২০ বছর ধরে ৩৮টি দেশের কয়েকশো বন্যপ্রাণীর ছবি তুলেছেন। দেশের কোনও রাজ্য বাদ নেই। মেরু সাগরে স্কুবা ডাইভিং থেকে বরফঢাকা পাহাড়ে ট্রেকিং, জলাভূমিতে গলাজলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা থেকে গাছের ডাল ধরে দিনভর উল্টো হয়ে ঝোলা— ছবির জন্য করেছেন অনেক কিছুই। দেশি-বিদেশি একাধিক ম্যাগাজিনে তাঁর তোলা ছবি প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার, সম্মান। আর বিপদ? ধৃতিমানের কথায়, ‘‘অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর উপস্থিত বুদ্ধি থাকলেই বিপদ এড়ানো যায়।’’ তবে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, কোনও ফ্রেমই সেই ছবির মূল চরিত্রের (সাবজেক্ট) ‘ভাল থাকার’ চেয়ে বড় হতে পারে না। আজকের ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে বন্যপ্রাণের ছবি তুলতে চাওয়া আলোকচিত্রী অথবা উৎসুক পর্যটকদের কাছে এই বার্তাই দিতে চান ধৃতিমান। চান, বন্যপ্রাণ ও তার বাস্তুতন্ত্র নিয়ে একটু ভাবুক সাধারণ মানুষ থেকে প্রশাসন, সক্কলে। সার্ডিন মাছের ‘বেট বল’ (সার্ডিন মাছের ঝাঁক, যা খেতে একত্রিত হয় বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও পাখি) ফ্রেমবন্দি করতে বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ফোনে ধৃতিমান বললেন, ‘‘বিজ্ঞান, সংরক্ষণ আর ভালবাসার কারণে ছবি তুলি। নিজের ভাবনাটুকু অন্যদের শুনিয়ে তাঁদের যদি এতটুকুও ভাবাতে পারি, সেটাই লক্ষ্য।’’
কতটা বিপন্ন ভারতের বন্যপ্রাণ? ধৃতিমানের উপলব্ধি, ‘‘এ দেশে মাত্র ১১ শতাংশ এলাকা জঙ্গল। বন্যপ্রাণী ও মানুষ সেখানে পাশাপাশি বসবাস করে। এখানে চোরাশিকার, খনির কাজ, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারই বন্যপ্রাণের জন্য বিপদ ডেকে আনে। এ সব যাঁরা করছেন, তাঁরা পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম নয় বলেই করছেন। বন্যপ্রাণ না থাকলে যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও থাকবে না, এটা তাঁরা ভাবতেই পারছেন না।’’ সেই সব মানুষদের একটু ‘ভাবাতেই’ আগামী ৩ জুলাইয়ের ওই অনুষ্ঠানে নিজের তোলা ছবি ও গল্পের ঝাঁপি খুলবেন বোহেমিয়ান এই ছবিওয়ালা।
বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা, আয়োজক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে জয়দীপ কুন্ডু বলেন, ‘‘বন্যপ্রাণীদের আচরণ সম্পর্কে ভাল ভাবে না জানার কারণেই আলোকচিত্রী বা পর্যটকেরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনেন। ছবি তোলার পরে যাতে সেই ফ্রেম আর কেউ না পায়, সে জন্য পাখির বাসা ভেঙে দিচ্ছেন ফোটোগ্রাফার— এমন ঘটনাও ঘটেছে! এই ধরনের অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে নবীন প্রজন্মকে জোরালো বার্তা দিতেই এমন উদ্যোগ।’’