সলমন রুশদির একটি চোখ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। ফাইল চিত্র
ভেন্টিলেটর থেকে চিকিৎসকরা তাঁকে বের করতে পেরেছেন। কিন্তু চোখটা রক্ষা করতে পারবেন কি? প্রশ্নটা রয়ে গিয়েছে। তাঁর হাতে স্নায়ুও ছিঁড়ে গিয়েছে। আবার কলম ধরতে পারবেন তো? এমনই সব প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে শুক্রবার নিউ ইয়র্কে আততায়ীর হাতে আক্রান্ত ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সলমন রুশদিকে নিয়ে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে ‘প্রতিবাদী’ কলকাতাকে নিয়েও।
অনেকেই বলেন, কলকাতা প্রতিবাদের শহর। কিন্তু সেই প্রতিবাদের শহর কি ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর লেখকের উপরে এমন বর্বরোচিত হামলা নিয়ে সে ভাবে সরব হল? হল কি? এই প্রশ্ন উঠছেই। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে বিপুল নগদ উদ্ধারের পরেও এই বাংলার বিশিষ্টদের বড় অংশ যেমন চুপ ছিলেন, রুশদির উপরে হামলাতেও তাঁরা যেন সেই একই ভাবে ঠোঁটে আঙুল রেখে বাধ্য স্কুলপড়ুয়া।
প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক তথা অভিনেত্রী অপর্ণা সেনকে। নেটমাধ্যমে তিনি বেশ কড়া শব্দেই লিখেছেন, ‘এমন ধর্মান্ধকে বিশ্ব ক্ষমা করবে না যে এমন বর্বর আক্রমণ করেছে। রুশদির মৃত্যু হলে সবচেয়ে সরব সাহিত্য ভাষা স্তব্ধ হয়ে যাবে, আঁধারের শক্তি জিতে যাবে।’ রাজনৈতিক আক্রমণও শানিয়েছেন অপর্ণা। টুইটারে লিখেছেন, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সাসের লেখককে কংগ্রেস সরকার তোষণ নীতির জন্য যে অসংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছিল তার আমি নিন্দা করি। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানাব স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সংবিধানের সম্মান রক্ষার্থে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হোক।’
এ বার তো রুশদিরও ৭৫ বছর। স্বাধীনতার বছরে ১৯৪৭ সালের ১৯ জুন, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের বোম্বে (বর্তমানে মুম্বই) শহরে জন্মগ্রহণ করেন আহমেদ সলমন রুশদি। এক কাশ্মীরি মুসলমান পরিবারে। অনেক ছোট বয়স থেকেই তিনি প্রবাসী। লেখক রুশদি ‘শেম’, ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’, ‘দ্য মুর’স লাস্ট সাই’, ‘দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’ ইত্যাদি উপন্যাস লিখে খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনই বিতর্কেও জড়িয়েছেন। ১৯৮৮ সালে লেখা ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটির জন্য ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। রুষ্ট হয় বিভিন্ন কট্টরপন্থী ইসলামি সংগঠন। এমনকি, রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও জারি করা হয়। মাথার দাম রাখা হয়েছিল ৩০ লক্ষ ডলার। ভারত-সহ ১৩টি দেশে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাসটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বার বার আক্রমণের হুমকি পেতে থাকা রুশদির জীবনে আর স্বস্তি আসেনি। কিন্তু কলম ও কণ্ঠও তাঁর থামেনি।
গত ১২ অগস্ট নিউ ইয়র্কের এক মঞ্চে ছুরি মেরে খুনের চেষ্টা হয় রুশদিকে। এই আক্রমণের প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু তেমন ভাবে কণ্ঠ ছাড়ল না ‘প্রতিবাদী’ বাংলা। অথচ রবার্ট ম্যকনামারার কলকাতা সফর থেকে শুরু করে ইরাকে আমেরিকার আক্রমণ— বাংলার প্রতিবাদ স্থানীয় পরিসর ছেড়ে যুগে যুগেই ঢুকে পড়েছে আন্তর্জাতিক আঙিনায়। রুশদি-কাণ্ডে অপর্ণা ছাড়া ফেসবুকে লিখেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জন দত্ত। নিন্দা করেছেন আক্রমণের। সঙ্গে লিখেছেন, ‘অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী।’ রুশদির উপরে হামলার নিন্দা করে ফেসবুকে লিখেছেন অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। কিন্তু এই ধরনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলেন না নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, আজ তাঁর নাটকের মঞ্চায়ন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তবে কি বাংলার বিশিষ্টরা একটু বেশিই চুপ? কবি সুবোধ সরকার জানালেন, ‘‘এমনিতে না বললেও, প্রশ্ন করলে সকলেই জানাবেন তাঁদের কথা।’’ তাঁর নিজের কথা কী? সুবোধ বলেন, ‘‘আমি কোনও লেখককে তাঁর ধর্ম দিয়ে, জাত দিয়ে, ইডিওলজি দিয়ে বিচার করি না। সলমন রুশদির ওপর নেমে আসা মুহুর্মুহু ছুরিকাঘাত যা আটকাতে চাইছে, তা আরও ফিনকি দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। ছুরি একজন লেখককে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু সত্যকে ভেন্টিলেটরে শুইয়ে রাখা যায় না। সলমন রুশদির লেখা আগে যে বিপুল পাঠক পড়ত, তার দশ গুণ পাঠক বেড়ে গেল ছুরিকাঘাতে। লেখককে খুন করলেই, তাঁর লেখাকে খুন করা যায় না। প্রাচীন রোম থেকে আধুনিক নিউ ইয়র্কে এ ভাবেই লেখকরা বেঁচে থাকেন জন-ইতিহাসে।’’
চিত্রশিল্পী তথা সম্প্রীতিবাদী শুভাপ্রসন্ন মনে করেন, সবেতেই সমবেত প্রতিবাদ করা যায় না। তিনি বলেন, ‘‘আমরা আলাদা আলাদা করে সবাই মর্মাহত। কিন্তু সবেতেই মিছিল করলে প্রতিবাদের ধার কমে যায়।’’ একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘হিন্দু দেবদেবীর উপরেও অনেকে অনেক কিছু করেছেন, এমন কী যিশু খ্রিস্টের উপরে লিখেছেন, কারণ, প্রতিটি মানুষের নিজের মতো করে দেখার অধিকার রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে, তাতে ধর্ম নষ্ট হয়ে যায় না। আমরা সোচ্চারে একে ঘৃণা করি। পৃথিবী যে বর্বরতার দিকে চলে যাচ্ছে তার লক্ষণ এটা।’’ আপনারা তবে চুপ কেন? শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘আমরা কখনওই চুপ নই। আমরা সংগঠিত ভাবে মিছিল হয়তো করছি না। আমাদের ব্যথা রয়েছে। কথায় কথায় রাস্তায় নামলে আমাদের ধার কমে যাবে।’’
বাংলার রাজনীতিও চুপই বলা যেতে পারে। শাসক দল তৃণমূলের মুখপত্রে ১১-র পাতায় জায়গা পেয়েছে রুশদির উপরে হামলার খবর। সিপিএমের মুখপত্রেও তথৈবচ। ছয়ের পাতায় একেবারে নীচে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এই খবর প্রথম পাতার নয়। সলমন রুশদি গত কয়েক বছরে খবরের শিরোনামে ছিলেন না। উনি বিতর্কেও ছিলেন না।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রশ্নটা হচ্ছে আমেরিকার মতো একটা দেশে এমন ঘটনা ঘটে কী করে?’’ দলের পক্ষ থেকে ঘটনার দিনেই নিন্দা প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও জানান সেলিম। ঘটনাচক্রে এই সেলিমের দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনই কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তাঁর বই ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধও করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। সেলিম মনে করেন, রুশদির মতোই এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন তসলিমাও।
রুশদিকে নিয়ে এই চুপ করে থাকার পিছনে সাহসের অভাব দেখছেন শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার। তিনি বলেন, ‘‘সলমন রুশদি একজন সাহসী ব্যক্তিত্ব। সতর্ক প্রহরায় তাঁকে যখন থাকতে হচ্ছিল তিনি ক্লান্ত বোধ করছিলেন। তিনি তো আবারও ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখতে চেয়েছিলেন। এমন এক জনের উপরে হামলায় যাঁরা প্রতিবাদ করছেন না, তাঁদের মধ্যে হয়তো সাহসিকতার অভাব রয়েছে।’’ একই সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মীরাতুন বলেন, ‘‘ধর্মের কোথাও এমন হিংস্রতার কথা বলা নেই। আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগ তো রয়েইছে। সাম্প্রদায়িকতাতে বিশ্বাস করে রাজনীতির যে ধারক-বাহকরা, যারা বিভাজনে বিশ্বাস করে তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। সে জন্যও চুপ থাকতে পারেন অনেকে।’’