মৃত পিঙ্কি ভট্টাচার্য(বাঁ দিকে)। সিএমআরআই হাসপাতালে চিকিৎসক বাসব মুখোপাধ্যায়কে চড়। ছবি: হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া ভিডিয়ো ফুটেজ থেকে
সন্তান জন্ম নেওয়ার ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু মায়ের। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় বিক্ষোভ, উত্তেজনা ছড়ায় একবালপুরের সিএমআরআই হাসপাতালে। হাসপাতালের অবহেলা আর গাফিলতিতেই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের। অভিযোগ খারিজ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীদের মারধর এবং হেনস্থার পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন মৃতার পরিজনদের বিরুদ্ধে। সিসিটিভি ফুটেজে চিকিৎসককে চড় মারার দৃশ্য দেখাও গিয়েছে।
মৃতার নাম পিঙ্কি ভট্টাচার্য (৩০)। হাওড়ার তাঁতিপাড়ার ওই বাসিন্দাকে মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুধবার সকালে তাঁর পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। বুধবার বেশি রাতে পিঙ্কির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটা নাগাদ মৃত্যু হয় পিঙ্কির। মৃতার পরিবারের তরফে হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশ সেই অভিযোগ মেডিক্যাল কাউন্সিলে পাঠাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসক সংগঠন ডক্টর্স ফর পেশেন্টস-এর তরফেও পুলিশের কাছে চিকিৎসক নিগ্রহের পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসেই বিনা চিকিৎসায় এক রোগিণীর মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছিল এই হাসপাতালেই।
পরিবার সূত্রের খবর, পেশায় ব্যবসায়ী তপেন ভট্টাচার্যর সঙ্গে কয়েক বছর আগে পিঙ্কির বিয়ে হয়। তপেনবাবুর কথায়, ‘‘রাতে পিঙ্কিকে স্যুপ জাতীয় খাবার দেওয়া হয়েছিল। তখন সে সুস্থই ছিল। আচমকা মৃত্যু কী ভাবে হল, কেউ স্পষ্ট বলছে না।’’ পিঙ্কির শাশুড়ি রিনা ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘২০২০ সালে শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে সুস্থ-সবল মায়ের মৃত্যু হয়? যে বাচ্চাটি জন্মাল, তার কী হবে বলতে পারেন?’’
দেখুন ভিডিয়ো:
জেনারেল বেডে থাকা অন্য রোগীর পরিবারের সদস্যদের একাংশ জানান, রাতে পিঙ্কির যন্ত্রণা হচ্ছিল। দ্রুত পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়েছিল কি না, স্পষ্ট নয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ পিঙ্কিকে আইসিইউয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আধ ঘণ্টা আগে সমস্যা দেখা দেয়। রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রক্তচাপ অস্বাভাবিক ছিল। অবস্থার অবনতি হলে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ-সহ যা যা করণীয়, সবই করা হয়েছে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।
মৃতার পরিবারের অভিযোগ, রাতে অবস্থা খারাপ বলে খবর দেওয়া হল। হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল পিঙ্কির মৃত্যু হয়েছে। রাতে অবস্থার অবনতি হলে তখনই কেন খবর দেওয়া হয়নি? কর্তৃপক্ষের দাবি, বাড়ির লোকের সঙ্গে বহু বার যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু লাইন পাওয়া যায়নি। কখন থেকে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু হয়? সেটা স্পষ্ট বলতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
স্বামী তপেন (বাঁ দিকে)। পিঙ্কি ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর নবজাতক। নিজস্ব চিত্র
পরিবারের আরও অভিযোগ, হাসপাতালে গিয়ে শোনা গিয়েছিল, আবাসিক চিকিৎসক সে সময়ে নেই। অথচ যিনি প্রথমে মৃত্যুর খবর দেন, পরে জানা গেল, তিনিই আবাসিক চিকিৎসক। তা হলে প্রথমেই সেটা বলা হল না কেন? পরিবারের দাবি, হাসপাতালের এক চিকিৎসক প্রথমে জানিয়েছিলেন, রাত সওয়া তিনটে নাগাদ মৃত্যু হয়েছে। পরে হাসপাতাল জানায়, পাঁচটা নাগাদ মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালের অভিযোগ, পিঙ্কির পরিবারের সদস্যরা এ দিন ভোরে আইসিইউ-এর সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। যার জেরে অন্য রোগীদের পরিষেবা দিতে সমস্যা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ। তাঁরা কোনও ভাবে পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে সেখান থেকে রিসেপশন চত্বরে সরিয়ে নিয়ে যান। এর পরে পরিবারের সদস্যদের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে সেখানে মৃত্যুর কারণ জানাতে শুরু করেন চিকিৎসক বাসব মুখোপাধ্যায়। অভিযোগ, সে সময়ে আচমকাই পিঙ্কির স্বামী চিকিৎসককে চড় মারেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, দুর্ভাগ্যজনক ওই ঘটনায় তাঁরা সমবেদনা জানাচ্ছেন। রোগীর পরিবার আইনের পথে যেতে পারেন। কিন্তু চিকিৎসককে মারধর, হাসপাতাল কর্মীদের হেনস্থা তাঁরা মানবেন না। রোগীর পরিবারের অভিযোগ, রাতে উপযুক্ত চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না হাসপাতালে। তার পরেও আলোচনার নামে একটি চেম্বারে ঢুকিয়ে পুলিশের সামনেই তাঁদের হেনস্থা করা হয়েছে। পরেও লাল গেঞ্জি পরা এক ব্যক্তি তাঁদের হেনস্থা করেন বলে অভিযোগ। ও দিকে হাসপাতালের দাবি, চিকিৎসক ছিলেন। ব্যবস্থাও মজুত ছিল। তাঁরা সব রকম চেষ্টা করেছেন।
চিকিৎসক বাসব মুখোপাধ্যায়ের অধীনে ভর্তি ছিলেন পিঙ্কি। ঘনিষ্ঠ মহলে বাসববাবু জানিয়েছেন, ‘প্রসূতিকে বাঁচাতে না পেরে আমারও খারাপ লাগছে। নিজের মনের অবস্থা কী, সেটা কাকে বোঝাব?’
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম, অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স-এর মতো সংগঠনগুলি জানিয়েছে, প্রসূতির মৃত্যু অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু একই সঙ্গে পুলিশ এবং কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনাও মেনে নেওয়া যায় না। এ ধরনের আক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসার প্রশ্নে ডাক্তারদের ভীত করে তুলবে।
দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়ানোয় হাসপাতালে এ দিন ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। যদিও ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে উত্তেজনা লাগাম ছাড়াল, প্রশ্ন প্রত্যক্ষদর্শীদের। কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা জানান, পুরো বিষয়টি ডিসি (দক্ষিণ)কে দেখতে বলা হয়েছে। পিঙ্কির দেহ ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে।