বেপরোয়া বাসের দৌরাত্ম্যের দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই। ফাইল ছবি
কখনও যাত্রী বোঝাই বাস রাস্তার ধারের বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে উল্টে যাওয়ার পরে জানা যায়, সেটির ফিটনেস সার্টিফিকেটই নেই। কখনও বেপরোয়া গতির বাস ফুটপাতে উঠে কয়েক জনকে পিষে মারার পরে সামনে আসে, বাসের স্পিডোমিটারের তার খোলা ছিল! কখনও আবার রেষারেষি করতে গিয়ে পথচলতি মানুষকে পিষে মারার পরে জানা যায়, বাসচালকের লাইসেন্স ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা হচ্ছিল ‘রিসোল টায়ার’, ফলে জরুরি সময়ে তাতে ব্রেক ধরেনি!
বেপরোয়া বাসের দৌরাত্ম্যের এমন ঘটনা ঘটে প্রায়ই। প্রতি বারই পুলিশ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায় বটে, কিন্তু তাতে আদৌ কাজ হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠে নতুন কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে। গত দেড় মাসে একের পর এক বাস দুর্ঘটনা সেই প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে। পুলিশ সূত্রের খবর, চলতি বছরের জুনের শেষ ১৫ দিনে শহরে প্রাণঘাতী বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে চারটি। পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত ১৮ জনের বেশি। প্রাণঘাতী নয়, এমন বাস দুর্ঘটনাগুলির ক্ষেত্রেও আহত অন্তত ১৫ জন। চলতি মাসের শুরুর দিকেও দুই বাসের রেষারেষিতে এ পি সি রোডে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে একটি বাসের পিছনে অন্য বাস ধাক্কা মারলে আহত হন পাঁচ জন।
মঙ্গলবার বেহালার বীরেন রায় রোডের ঘটনা সেই তালিকাই আরও দীর্ঘ করল। এই ঘটনায় একটি বেপরোয়া বাস প্রথমে একটি অ্যাপ-ক্যাবে এবং পরে রাস্তার অন্য লেনে চলে গিয়ে একটি স্কুলগাড়ি ও একটি অটোয় ধাক্কা মারে। শেষে ধাক্কা মারে একটি আবাসনের দেওয়ালে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন ছ’জন।
কিন্তু বার বার কেন এমন ঘটনা ঘটছে? এ দিনের দুর্ঘটনা ঘটানো বাসটির এক যাত্রীর দাবি, ‘‘বাসটি সম্ভবত ব্রেক ফেল করেছিল, নয়তো ব্রেক ধরেনি।’’ তাপ্পি মারা চাকা ব্যবহার করার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা। কলকাতা পুলিশের ফেটাল স্কোয়াডের এক অফিসার বললেন, ‘‘গত কয়েক মাসের বেশির ভাগ বাস দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে রিসোল টায়ার। মূলত খরচ বাঁচাতেই বাসমালিকেরা এমন চাকা ব্যবহার করেন।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হতে থাকা চাকা না বদলে দোকানে দিয়ে তার উপরেই অনেক কম খরচে এক ধরনের পুরনো চাকার আস্তরণ লাগানো হয়। কিন্তু ব্যবহার হতে হতে সেটিও এতটাই ক্ষয়ে যায় যে, রাস্তায় পিছলে যায়। জোরে ব্রেক কষলেও বাস থামে না। রোদের তাপে এই ধরণের তাপ্পি মারা চাকা ফেঁসেও যায় যখন-তখন। ফলে এর সঙ্গে অন্য কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ থাকলে দুর্ঘটনা আটকানো প্রায় অসম্ভব। পুলিশের আরও দাবি, এর সঙ্গে রয়েছে খরচ বাঁচানোর নামে ভাল যন্ত্রাংশ ব্যবহার না করার এবং দায়সারা ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের প্রবণতা।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস অ্যান্ড মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক প্রদীপনারায়ণ বসু অবশ্য গাফিলতি মেনে নিয়েই বললেন, ‘‘পথে নামতে গেলে যে কোনও ব্যক্তিগত গাড়ির কিছু না কিছু সমস্যা থাকেই। যন্ত্রপাতি একেবারে ঠিকঠাক করে নিয়ে সব সময়ে এগোনো যায় না। তা ছাড়া শহরের বেশির ভাগ বাসেরই মেয়াদ আর মেরেকেটে তিন-চার বছর। দুর্ঘটনা আটকানো তো পরের কথা, সরকার কোনও ভাবে এগিয়ে না এলে এর পরে আর বাসই চালানো যাবে না।’’ ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘লকডাউনের দু’বছর বাসগুলি স্রেফ বসে ছিল। বিমার টাকা মেটানো, ফিটনেস সার্টিফিকেট করানোর খরচ মিলবে কোথা থেকে? এর পরে কী আর ভাল ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার পরিস্থিতি থাকে?’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, সরকারি সাহায্যে তাঁদের সংগঠনের তরফে এক সময়ে বাসচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। তাতে বাস চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি লাইসেন্স পরীক্ষা, চক্ষু পরীক্ষা এবং চালকের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষাও করানো হত। যাতে কোনও অঘটন ঘটলে যাত্রীদের পাশাপাশি চালকের পাশেও দাঁড়ানো যায়। কিন্তু এখন এর সবই বন্ধ। তপনবাবুর মতে, ‘‘কড়া আইন প্রণয়ন করলেই সব সময়ে সবটা হয় না। দুর্ঘটনা ঘটছে কেন, সেটা খুঁজে বার করে তার মূলে গিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হয়।’’