সময়-সাক্ষী: হগ মার্কেট থেকে নিউ মার্কেট— একশো বছরেরও বেশি ইতিহাস ধরা রয়েছে শহরের এই প্রাণকেন্দ্রে। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘নেটিভ’-দের সঙ্গে একসঙ্গে বাজার করায় প্রবল আপত্তি ছিল ব্রিটিশদের। আর সেই সূত্রেই জন্ম হয় নিউ মার্কেটের। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ১৮৭১ সাল থেকে কলকাতার ব্রিটিশরা দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের জন্য একটা পৃথক মার্কেট তৈরি করা হোক। সেই দাবি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তাতে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিল কলকাতা পুরসভাও (তখন নাম ছিল ‘ক্যালকাটা কর্পোরেশন’)। ব্রিটিশদের দাবিকে বাস্তবায়িত করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন পুরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান স্যর স্টুয়ার্ট হগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন মার্কেটের নকশা তৈরির।
শেষ পর্যন্ত ১৮৭৪ সালের পয়লা জানুয়ারি নতুন মার্কেট শুরু হয়। আর হগের উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে ১৯০৩ সালে যার নামকরণ হয়েছিল ‘স্যর স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কিন্তু সেই নির্মাণের ১৪৭ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, মার্কেটের হেরিটেজ অংশের কাঠামোর, বিশেষ করে ছাদের জরুরি ভিত্তিতে মেরামতি প্রয়োজন। না-হলে বড়সড় কোনও বিপদের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
কারণ তাঁদের বক্তব্য, বহু বছর ধরেই মার্কেটে প্রয়োজনীয় আমূল সংস্কারের কাজ হয়নি। যেটুকু হয়েছে সে-সবই হল ‘প্যাচ ওয়ার্ক’ বা তাপ্পি দেওয়ার কাজ। সেই তাপ্পি দেওয়া বা সাময়িক ভিত্তিতে মেরামতির কাজের জন্য সম্প্রতি সাড়ে ৫৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দও করেছেন পুর কর্তৃপক্ষ। ওই কাজের মধ্যে মার্কেটের ছাদ মেরামত (রুফ ট্রিটমেন্ট) ও বিভিন্ন অংশের কাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকের আশঙ্কা, আমূল সংস্কারের পরিবর্তে ধারাবাহিক ভাবে সাময়িক ভিত্তিতে করা মেরামতির কাজ যেন বড়সড় কোনও বিপদ না ডেকে আনে! এর কারণ ব্যাখ্যা করে সংশ্লিষ্ট মহল জানাচ্ছে, নিউ মার্কেট তৈরির সময়ে ‘ফ্ল্যাট রুফ’ বা এখনকার মতো ছাদ তৈরির রীতি ছিল না। কারণ তার জন্য কংক্রিট, বিম, টাইলসের প্রয়োজন পড়ত। ফলে কংক্রিট না থাকায় সম্ভবত চুন-সুরকি দিয়েই নিউ মার্কেটের ‘সিলিন্ড্রিকাল শেল রুফ’ বা নলাকৃতি কাঠামোর ছাদ তৈরি করা হয়।
তবে এই ধরনের কাঠামোর একটি সমস্যা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, কংক্রিটের ছাদ দুর্বল হলে বা সংশ্লিষ্ট কাঠামোর কোথাও ক্ষয় হলে সচরাচর সেই অংশ থেকে চাঙড় ভেঙে পড়ে। কিন্তু পুরনো দিনের ‘শেল রুফ’ যা নিউ মার্কেটের হেরিটেজ অংশে রয়েছে, সেগুলির কাঠামো দুর্বল হলে এবং ঠিক সময়ে সংস্কারের কাজ না হলে নলাকৃতি ছাদের পুরোটাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা এই মার্কেটের হেরিটেজ অংশ অক্ষুণ্ণ রেখেই তাকে সমকালীন করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। শুধু মার্কেটের বাইরেই নয়, ভিতরেও। এ ক্ষেত্রে বিদেশের বিভিন্ন মার্কেটের উদাহরণও দিচ্ছেন তাঁরা।
এমনিতে মার্কেটের সংস্কারের জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে পুর কর্তৃপক্ষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফেই সংস্কারের বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরির কথা। সে কথা ইতিমধ্যেই পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অনুমোদনের প্রস্তাব রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হলেও এখনও তা আসেনি বলে পুরসভা সূত্রের খবর।
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা হেরিটেজ-স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশের মতে, ‘‘নিউ মার্কেটের আমূল সংস্কার করার ক্ষেত্রে দু’টি প্রধান সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, প্রচুর
অর্থের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সংস্কারের কাজ করতে গেলে বেশ কিছু দিনেরজন্য অনেক দোকান বন্ধ রাখা প্রয়োজন। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট দোকানদারেরা কতটা সম্মতি দেবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে নিউ মার্কেটের এক ব্যবসায়ীর বক্তব্য, ‘‘মার্কেট ঝাঁ-চকচকে করতে গিয়ে দোকান বন্ধ করাটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, দৈনিক বিক্রি-বাটার উপরেই আমাদের সংসার চলে।’’ ‘এস এস হগ মার্কেট শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক জায়েদ (বাবলু) আলম অবশ্য বলছেন, ‘‘মার্কেটের সংস্কারের কাজ করা হবে বলে শুনতে
পাচ্ছি। কিন্তু কত দিনে তা হবে, সেটাই প্রশ্ন। তার মধ্যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কে নেবে!’’