অতিরিক্ত ওজন নিয়ে রাতের শহরে চলছে একটি লরি। শুক্রবার, বি বা দী বাগ এলাকায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
গত বছরের মাঝামাঝি মধ্যরাতে এক পুলিশকর্মীকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে একটি লরির বিরুদ্ধে। লরিটি চম্পট দেওয়ার মুহূর্তে সিসি ক্যামেরায় যে দৃশ্য ধরা পড়ে, তাতে দেখা যায়, একের পর এক বস্তার ভারে লরিটি এতটাই ভারাক্রান্ত যে, সেটি এক দিকে হেলে চলছিল। তা দেখেই সম্ভবত লরিটিকে দাঁড় করাতে গিয়েছিলেন কর্তব্যরত সেই পুলিশকর্মী। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল মানিকতলার কাছে। মাত্রাতিরিক্ত ভার নিয়ে ছুটতে গিয়ে ফুটপাতে উঠে পড়ে তিন জনকে পিষে দেয় একটি ছ’চাকার লরি! মুর্শিদাবাদে আবার পালাতে গিয়ে এমনই একটি লরির চালক চাকা তুলে দেন এক পরিবহণকর্মীর পায়ের উপরে। এমন লরির বিরুদ্ধে মোটর ভেহিক্ল অফিসারকে পিষে মারার অভিযোগও ওঠে হাওড়ায়।
কিন্তু কালনার মতো ঘটনা কবে ঘটেছে, মনে করতে পারছেন না পুলিশ থেকে পরিবহণ আধিকারিকেরা। যেখানে মাত্রাতিরিক্ত ভার নিয়ে চলা লরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সরাসরি গুলির মুখে পড়তে হয়েছে পরিবহণ অফিসারকে। এমনকি, প্রায় ২৫ কিলোমিটার ধাওয়া করে তাঁকে প্রাণে মারার চেষ্টা হয়েছে বলেও অভিযোগ। ধাওয়া করার সময়েও ছোড়া হয়েছে একের পর এক গুলি! এই পরিস্থিতিতেই শুক্রবার রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে দেখা করেন লরিমালিক ও চালকদের কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সেখানে দ্রুত এমন পরিস্থিতি বদলের দাবি জানানো হয়েছে বলে খবর। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, মাঝে বন্ধ হলেও নতুন করে শুরু হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ভার বহনকারী লরির দৌরাত্ম্য। অবাধে এমন লরি কলকাতায় ঢুকছে বলেও তাঁদের অভিযোগ।
‘ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সজল ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘এমন সমস্ত লরির সঙ্গে আলাদা হিসাব করা থাকে প্রশাসনের একাংশের। সেই হিসাবের জোরে সহজেই পাওয়া যায় লরির ‘গ্রিন করিডর’! সেই করিডরে কেউ ধরবে না। অতিরিক্ত ওজন বহন বা সিগন্যাল ভাঙার অভিযোগে মামলা হবে না। চালক মত্ত কি না, কেউ জানতেও চাইবেন না। বিপত্তি ঘটালেও মামলা-মোকদ্দমা হবে না! এমনকি, বেপরোয়া গতিতে কাউকে পিষে মারলেও সহজেই আত্মগোপন করতে পারবেন লরির চালক। এ জিনিস একদম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে শুরু হচ্ছে দেখে আমরা মন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছিলাম।’’
লরিমালিকদের সংগঠনগুলির দাবি, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম বদল করে জানায়, একটি ট্রাক ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ওজন নিতে পারবে। একে ‘সেফ অ্যাক্সেল লোড’ বলা হয়। কিন্তু সর্বভারতীয় ওই বিধি প্রথমে এ রাজ্যে মানা হচ্ছিল না। রাজ্যের নিয়ম ছিল, ট্রাক তার বহন-ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য তুলবে, অতিরিক্ত ভার নিতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছিল, তিন-চার গুণ বেশি ওজন নিয়ে লরি শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য কেন্দ্রের নিয়ম চালু করে। জানিয়ে দেওয়া হয়, মাত্রাতিরিক্ত ভার বহন করলে প্রথম বার ২০ হাজার টাকা জরিমানা এবং প্রতি টন অতিরিক্ত ওজনের জন্য দু’হাজার টাকা করে অতিরিক্ত জরিমানা নেওয়া হবে। দ্বিতীয় বার অপরাধের ক্ষেত্রে জরিমানা দ্বিগুণ করার এবং তৃতীয় বার অপরাধের ক্ষেত্রে পারমিট বাতিলের যে সংস্থান রয়েছে কেন্দ্রের আইনে, তা-ই করা হবে।
বর্তমানে ছ’চাকার লরি ১২ টন, ১০ চাকার লরি ১৮ টন, ১২ চাকার লরি ২৬ টন, ১৪ চাকার লরি ৩০ টন এবং ১৬ চাকার লরি ৩৪ টন পণ্য বহন করতে পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তিন থেকে চার গুণ বেশি ওজন বহন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কলকাতা এবং হাওড়ায় শক্ত হাতেই সব নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এখানে সেই ব্যাপার নেই। তা ছাড়া, পরিবহণ অফিসারদের কড়া হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরেই কিন্তু এই ধরনের ঘটনাগুলি ঘটছে। আমরা পুলিশে অভিযোগ করেছি। কড়া হাতেই পদক্ষেপ করা হবে।’’