প্রতীকী ছবি।
পাম্পে ঢুকতেই সেখানকার এক কর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, পেট্রল না ডিজ়েল? উত্তর পেট্রল শুনে খানিক নিরুৎসাহী তিনি। কী ব্যাপার? এর পরে ওই কর্মী বললেন, ‘‘ডিজ়েল হলে আলাদা জিনিস ছিল। ৮৫ টাকা লিটার!’’
দেশ জুড়ে প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে পেট্রল, ডিজ়েলের দাম। এ রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় ইতিমধ্যেই দামে সেঞ্চুরি করেছে ডিজ়েল। কলকাতাতেও রবিবার ইন্ডিয়ান অয়েলের পাম্পে ডিজ়েলের দাম ছিল ৯৯.৮৩ টাকা। সেখানে মাত্র ৮৫ টাকা লিটারে ডিজ়েল বিক্রি হয় কী ভাবে? অন্য গাড়ির জন্য খোঁজ নিয়ে যেতে চাই জানিয়ে ওই কর্মীর সঙ্গে গিয়ে দেখা গেল, বড় বড় টিনের পাত্রে একটি তরল রাখা। আদতে যা ‘কাটা তেল’ হিসেবেই পরিচিত। ডিজ়েলের রঙের সঙ্গে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। মাঝেমধ্যেই ক্রেতারা টিনের পাত্রে বা বোতলে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন সেই তেল। কলকাতাতেও এই তেল বিক্রি হয়? ওই কর্মী বললেন, ‘‘যে হারে জ্বালানির দাম বাড়ছে, তাতে অন্য উপায় তো খুঁজতেই হচ্ছে। এগুলোরও ভাল রকম চাহিদা এখন।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত কয়েক দিনে শহরের বেশ কিছু জায়গায় এমনই কাটা তেলের কারবার শুরু হয়েছে বলে তাদের কাছেও অভিযোগ আসছে। মূলত পেট্রল পাম্পগুলির ছত্রচ্ছায়াতেই এমন ব্যবসা ফাঁদা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এর সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্র। ঘুরপথে জেলা এবং শহরতলি থেকে ভেজাল তেল এসে পৌঁছচ্ছে শহরে। পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই এ নিয়ে তৎপর হয়েছে পুলিশের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি)। লাগোয়া জেলাগুলি থেকে শহরে প্রবেশের পথগুলিতে কড়াকড়ি বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্রেতাদেরও এ নিয়ে সতর্ক হতে বলা হয়েছে।
একাধিক জেলায় এবং শহরতলিতে মূলত ডিজ়েলচালিত যানবাহন বা অন্য যন্ত্রে ডিজ়েলের পরিবর্তে কাটা তেল ব্যবহার হয়। এগুলি অত্যন্ত দূষণ ছড়ায়। তবু জেলার অটো, ট্রাক, ভ্যান, ভুটভুটি থেকে শুরু করে জমিতে সেচের কাজে ব্যবহৃত হওয়া পাম্প এবং জেনারেটর ঘিরেও এমন তেলের রমরমা কারবার চলে বলে অভিযোগ। সাধারণত, কেরোসিনের সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি হয় এই তেল। প্রথমে কেরোসিনের মধ্যে দেওয়া হয় ব্লিচিং পাউডার। সঙ্গে সঙ্গে কেরোসিনের রং বদলে সাদাটে হয়ে যায়। পরে তাতে মেশানো হয় গিয়ার অয়েল। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই তেলের রং প্রায় ডিজ়েলের রং ধারণ করে। ঠিকঠাক মাত্রায় মেশাতে পারলে এই ভেজাল তেল আর ডিজ়েলের মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল। এই ব্যবসায় যুক্ত এক ব্যক্তি জানালেন, এক লিটার কেরোসিন তেলে ২০০-২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ও ৫০ গ্রাম গিয়ার অয়েল দেওয়া হয়। এক লিটার কাটা তেল তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সেটাই জেলার বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করা যায়। মূলত মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়ানোর কারণে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কখনওই কোনও জেলাতেই এই তেলের বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়নি। এখন এমন তেলই শহরে ঢুকছে বলে অভিযোগ।
‘পশ্চিমবঙ্গ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক প্রসেনজিৎ সেন যদিও বললেন, ‘‘দাম বাড়ায় পাম্প মালিকেরা সমস্যায় পড়েছি। বিক্রি কমেছে ঠিকই, কিন্তু কলকাতার কোনও পাম্পের সঙ্গে এমন ব্যবসার যোগাযোগ নেই। তবু সংগঠনের সকলকে সতর্ক করব।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত অবশ্য বললেন, ‘‘কলকাতাতেও বেশ কিছু জায়গায় বোতলবন্দি এমন তেল দেখছি। শুধু ব্লিচিং পাউডার বা গিয়ার অয়েল কেন, পেট্রলের সঙ্গে অনেক সময় ডিজ়েলও মেশানো হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউ (নিরি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট দূষণের ২১ শতাংশ এমনিতেই পরিবহণ ক্ষেত্র থেকে হয়। এমন তেলের ব্যবহার বাড়লে দূষণের মাত্রা কোথায় পৌঁছবে, সেটাই দেখার।’’