পাঠমগ্ন: বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার, আইসিসিআরে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
বিশ্বের অন্যতম শক্ত কাজ ভারতের মতো দেশে ভাল ডাক্তার হওয়া। এমনটাই মনে করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিচার করে, সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে এখানে চিকিৎসা করতে হয়।
মঙ্গলবার লিভার ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে শতাধিক বাঙালি চিকিৎসকের জীবনের বিভিন্ন দিকের সংকলন ‘একশো তারার আলো’ গ্রন্থের প্রকাশ করেন অভিজিৎ। তাঁর মতে, অন্য দেশে যে ধরনের যন্ত্রপাতি এবং সহজে পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তা এখানে নেই। থাকলেও তা ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হতে হয়, কারণ কত খরচ হবে আর তা সকলে দিতে পারবেন কি না, তা ভেবে। বিদেশে এই বিচার না করে পরীক্ষা-নির্ভর চিকিৎসা হয়। অনেকে কষ্টের কথা ঠিক মতো বলতে পারেন না। দারিদ্রের কারণে অনেকে পরীক্ষার কথা শুনেই পালিয়ে যান। অভিজিৎ বলেন, ‘‘এই তিন সমস্যা নিয়ে এখানে ডাক্তারদের বাঁচতে হয়।’’
তাই ছোট ছোট সূত্রকে জুড়ে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকদের অসুখ নির্ণয় করে রোগীকে সারিয়ে তুলতে হয়। বুঝতে হয় রোগীর সামাজিক স্থিতি আর সর্বশেষে মনস্তত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব। এর জন্য অসামান্য ধৈর্য ও সহমর্মিতার প্রয়োজন বলেও মত অভিজিতের। বর্তমানে রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্কের অবনতির পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের আরও ধৈর্যশীল ও সহমর্মী হওয়ার বার্তাও দেন তিনি। বলেন, ‘‘বইয়ে যাঁদের কথা তুলে ধরা হয়েছে, তাঁদের খোলা মন, দরদ ও ধৈর্য ছিল।’’ শিশুরোগ চিকিৎসক শিশির বসুর পুত্র সুগত বসু বলেন, ‘‘শুধু পেশা নয়। এ দেশে চিকিৎসা হচ্ছে বিশেষ ধরনের জনসেবা।’’
১০৫ জনের চিকিৎসা-পেশার বাইরেও সাহিত্যচর্চা, রাজনীতির অঙ্গনে থেকে মানবকল্যাণ, চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী গবেষণা, শিক্ষকতা ও চারিত্রিক গুণাবলীর আলোচনা রয়েছে বইটিতে। যেমন, ১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘সায়াটিকা’-য় শয্যাশায়ী ও আদালতে হাজিরা দিতে অক্ষম বলে শংসাপত্র দেন শল্য চিকিৎসক পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়। তার পরেই সুভাষ নিরুদ্দেশ হন। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুপ্রাপিউবিক সিস্টোস্টমি’ অস্ত্রোপচার করেন ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক দিন পরে কবির মৃত্যু হয়। বইতে রয়েছে, আজকের প্রেক্ষাপটে হয়তো ললিতমোহনকে শুনতে হত, ‘চক্রান্ত করে বাংলার রবিকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ অনুসন্ধান কমিটি হত। প্রশ্ন উঠত, কবি চাইলেও চিকিৎসক বাড়ির বারান্দায় কেন অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি নিলেন? বলা হত, ‘অবশ্যই বাহবা পাওয়ার তাগিদে।’ যদিও নামের আগে মিস্টার লেখাই পছন্দ ছিল ললিতমোহনবাবুর।
বইয়ে রয়েছে এশিয়ায় প্রথম শব ব্যবচ্ছেদকারী মধুসূদন গুপ্ত অথবা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, অশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিকুমার ছেত্রী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী-সহ আরও অনেকের কথা। আয়োজকদের তরফে চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘গল্প বলার ঢঙে এই মানুষগুলিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস এটি। যাতে আগামীর চিকিৎসকেরা প্রেরণা পেতে পারেন।’’ ভবিষ্যতে এক হাজার চিকিৎসকের কথা তুলে ধরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সংস্থার সম্পাদক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়। বইয়ে উল্লেখ সুবীর চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ গুহমজুমদার, অরুণাভ চৌধুরীরাও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।