চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-গিরিশ পার্ক

মাঝরাতে বিপদ হলেও পাশে পাওয়া যায় প্রতিবেশীদের

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরেই আমার বাড়ি। পাশের রাস্তা আশুতোষ দে লেন। তার পাশে রামদুলাল সরকার স্ট্রিট। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের অন্য ধারে লিবার্টি সিনেমা হলের এক ধারে অদ্বৈত মল্লিক লেন। অন্য ধারে রমেশ দত্ত স্ট্রিট।

Advertisement

সরোজকুমার ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:৪৪
Share:

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরেই আমার বাড়ি। পাশের রাস্তা আশুতোষ দে লেন। তার পাশে রামদুলাল সরকার স্ট্রিট। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের অন্য ধারে লিবার্টি সিনেমা হলের এক ধারে অদ্বৈত মল্লিক লেন। অন্য ধারে রমেশ দত্ত স্ট্রিট। গিরিশ পার্ক চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের এই অঞ্চলই আমার পাড়া। এখানেই আশি বছর কাটিয়ে দিলাম।

Advertisement

১৯০৬ সালে ঠাকুরদার বাবা প্রায় ষাট বছরের পুরনো এই বাড়িটি কেনেন। থাম আর নকশা করা খিলানের পরপর সব বাড়ি। একটার সঙ্গে অন্যটার ফাঁক নেই বিশেষ। একশো-দেড়শো বছরের জীর্ণ বাড়িগুলিতে ইঁদুরের উৎপাতও খুব। তবু আঁকড়ে রেখেছি ভিটে। তাই ফ্ল্যাট সংস্কৃতি থাবা বসায়নি এখানে। তবে নতুন প্রজন্ম অন্যত্র চলে যাওয়ায় অবশ্য এলাকায় বাঙালির সংখ্যা কমছে।

এই পাড়ার ল্যান্ডমার্ক লিবার্টি সিনেমা প্রথমে জুপিটার নামে পরিচিত ছিল। পরে হয় চিত্রলেখা। ষাট-সত্তর বছর আগে নাম বদলে হয়েছে লিবার্টি।

Advertisement

সেই সময়ে বাড়ির টানা বারান্দাগুলোয় কঞ্চি-কাঠির পর্দা ঝোলানো থাকত। তারই ফাঁক দিয়ে মা-ঠাকুরমারা বাইরের জগত দেখতেন। এই বারান্দা থেকেই প্রথম স্বাধীনতার উৎসব দেখেছিলাম। দাদুর সঙ্গে বসে গোটা পরিবার সাক্ষ্মী থেকেছিলাম বয়স্ক-যুবক-শিশুদের চিৎকার আর মধ্যরাতের বাঁধভাঙা আনন্দের।

এ পাড়ায় কোনও দিনই গাছপালা, খেলার মাঠ ছিল না। আমরা খেলতাম চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে। এখনের থেকে সেগুলো তিন গুণ বেশি চওড়া ছিল। দাদুরা ফুটপাথের রকে বসে গল্প করতেন আর ছোটদের পাহারা দিতেন।

তখন অন্যতম চওড়া রাস্তা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে কত ভিআইপি-দের যেতে দেখেছি। নেহরুকেও কয়েক বার দেখেছি বাড়ির বারান্দা থেকেই।

দাদু ছিলেন কড়া ধাঁচের মানুষ। অজিত পাঁজা তখন কিশোর। সন্ধ্যার পরেও বল নিয়ে রাস্তায় একটা কিশোর ঘুরছে দেখে লাঠি উঁচিয়ে তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত তাড়া করেছিলেন দাদু। পরে অজিতবাবুর থেকেই এইগল্প শুনেছি।

বাসিন্দাদের মধ্যে মিলমিশ আগেও ছিল, এখনও আছে। সে সবের দু’-একটা গল্প বলি। আটের দশক। কলকাতা জুড়ে মেট্রোর কাজ চলছে। এর জেরে জলের লাইনে বড়সড় সমস্যা হল। মাসাধিক কাল জল সরবরাহ বন্ধ। কাশী বিশ্বনাথ ও পুরসভার যে জলের গাড়ি এলাকায় আসত, তা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। এক দিন বাড়ি বাড়ি চিরকূট পাঠিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ অবরোধ করা হল। সঙ্ঘবদ্ধ এই আন্দোলনে কাজও হল।

আর এক বার ভুলবশত সদর দরজা হাট করে উপরে উঠে যাই। সারা রাত সেই খোলা দরজা পালা করে আগলে বসেছিলেন এলাকারই দু’জন দেহাতি ব্যবসায়ী। এখনও রাত-বিরেতে কেউ অসুস্থ হলে, পাশে দাঁড়ানোর লোকের অভাব হয় না এখানে। বাসিন্দারা আজও পা়ড়ায় পুজোর প্রসাদ বিতরণ করেন।

তবে এ পাড়ায় আড্ডাটা আর সে ভাবে বসে না। তবু সন্ধ্যার দিকে দাদুর কেবিনে এখনও আড্ডার ঝলক দেখা যায় কিছুটা।

চালিশিল্প এই পাড়ার গর্ব। আদত মেদিনীপুরের বাসিন্দা ডোমপাড়ার এই শিল্পীরা বহু বছর আগে এখানে চলে আসেন। বাঁশের কাজের এই শিল্প দেশ-বিদেশে সমাদৃত। তিন বছরের বাচ্চার হাতেও হাতুড়ির ‘ঠুকঠুকানি’ অবাক করে পথচলতি মানুষকেও। প্রশাসন এই শিল্পের রক্ষায় সচেতন হলে শিল্পীরাও বাঁচবেন।

পুরনো কাপড় নিয়ে মাঝরাতে বসা হাট আরও একটা দেখার বিষয় এই এলাকায়। দু’জন কাবুলিওয়ালার উদ্যোগে শুরু হয়েছিল একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই ব্যবসা। আগে রাত ১২টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলত। পাড়ার লোকেদের ঢুকতে-বেরোতে খুবই সমস্যা হত। পুলিশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করায় এখন বসে রাত তিনটে থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত।

পুরসভার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এ পাড়ার কাউন্সিলর তারকনাথ চট্টোপাধ্যায় এলাকার উন্নয়নে যথাসাধ্য কাজ করেন। নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয়। আলো-জলও পর্যাপ্ত এখানে।কিন্তু রাস্তার কুকুর-বেড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় ইঁদুরের সমস্যা খুব। বিপজ্জনক ভাবে ফুটপাথ ফুঁড়ে উঠে আসে ইঁদুর। এর সমাধানে পুরসভা নজর দিলে বাসিন্দাদের উপকার হয়।

হয়তো জায়গার অভাবেই এখানে বড় কোনও বারোয়ারি পুজো হয় না। আশুতোষ দে লেনে রয়েছে মিত্র বাড়ির গুপ্ত বৃন্দাবন ধাম। মিত্র বাড়ির কলকাতা শাখার প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মিত্র এই কৃষ্ণ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। এ ছাড়া রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বসাকালীও অন্যতম প্রাচীন কালীমন্দির।

এ পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। প্রাক্তন ওই রাজ্যপালকে বৃদ্ধ বয়সেও মিনিবাস চেপে যাতায়াত করতে দেখেছি। এখানেই থাকতেন বিপ্লবী অমর বসু, ঢোলশিল্পী বরেন দাস। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায়ের অবদান এলাকার পুরনো বাসিন্দারা আজও মনে করেন।

পুরনো এই সব কিছুর টানে এখনও পাড়া ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু দু’হাত দিয়ে আপ্রাণ আগলে রাখার চেষ্টাটা হয়তো বা এই প্রজন্ম পর্যন্তই।

লেখক চিকিৎসক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement