বুকের বাঁ দিকের ক্ষতচিহ্ন থেকে রক্ত চুঁইয়ে গাড়ির সিট হয়ে নীচে পড়ছে। স্টিয়ারিংয়ের সামনে আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকা যুবক নিথর। তাঁর ডান দিকে পায়ের কাছে পড়ে আছে একটি দেশি বন্দুক। গাড়ির মধ্যেই পড়ে মদের খালি দু’টি বোতল ও একটি মোবাইল ফোন।
মানিকতলা এলাকার মুরারিপুকুরে বোমার মাঠের কাছে দাঁড় করানো ছোট মালবাহী গাড়িটা। চালকের কেবিনের জানালার সব কাচ তোলা। দু’পাশের দরজাই ভিতর থেকে বন্ধ।
বুধবার সকাল থেকে ওই যুবকের খোঁজ মিলছিল না। খুঁজতে খুঁজতে কিছুক্ষণ পর কয়েক জন প্রতিবেশী দেখেন ওই দৃশ্য। পেশায় গাড়িচালক কানাই সাউ (১৮) যে গাড়িটি চালাতেন, তার মধ্যেই পাওয়া গেল ওই যুবকের গুলিবিদ্ধ দেহ। এলাকায় কানাই তৃণমূলকর্মী হিসেবে পরিচিত। মঙ্গলবার রাতেও বিধানসভা ভোটের জন্য তিনি দলের সমর্থনে দেওয়াল লিখেছিলেন। তার পর রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে রোজকার মতো পাশের একটি ক্লাবে তিনি শুতে চলে যান।
কিন্তু সকালে কানাই না ফেরায় বাড়ির লোকজন ওঁর মোবাইলে বার বার ফোন করলে সেটি বেজে গিয়েছে। পরে জানা যায়, বাড়ি থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে কানাইকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গাড়ির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। গাড়ির মধ্যে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনটি কানাইয়ের বলেই পুলিশ জেনেছে।
সামনে ভোট। তার উপর কানাইয়ের সঙ্গে রাজনীতির যোগ ছিল। তাই, তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পরেই স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ এর মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
তবে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে ওই যুবক আত্মঘাতী হয়েছেন। কেন তিনি আত্মহত্যা করলেন, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’’ গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, আত্মহত্যার পিছনে প্রণয় ঘটিত কারণ রয়েছে।
যদিওএ কানাইয়ের দাদা কিষাণ সাউয়ের অভিযোগ, ‘‘আমার ভাইকে খুন করা হয়েছে।’’ তবে রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেননি নিহত যুবকের পরিবারের সদস্যেরা। ওই বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী, মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের দাবি, ‘‘দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কোনও ঘটনা এখানে নেই।’’ তবে তাঁরও দাবি, কানাইকে খুন করা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে কানাইয়ের মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্তে যিনি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কানাইয়ের বচসা হয়েছিল বলে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। কার সঙ্গে বচসা হয়েছিল, সেটা কানাইয়ের মোবাইলের কল ডিটেলস রেকর্ড ঘেঁটে বার করার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।
এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ ওই মালবাহী গাড়ির চালকের কেবিনের পিছনে স্লাইডিং কাঁচের জানালা খুলে হাত ঢুকিয়ে গাড়ির দরজা খোলেন। তার পর কানাইয়ের মৃতদেহ বার করা হয়।
তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, মঙ্গলবার ভোর চারটে বা তার কিছু আগে ঘটনাটি ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে ওই তল্লাটের বাসিন্দারা গুলির শব্দ পেলেন না কেন? পুলিশের মতে, এ দিন ভোরে প্রচুর বজ্রপাত হয়েছে। সেই আওয়াজেই সম্ভবত চাপা পড়ে গিয়েছে গুলির শব্দ।
কিন্তু পুলিশ কেন প্রাথমিক ভাবে এটিকে আত্মহত্যার ঘটনা বলছে?
এক তদন্তকারী অফিসার জানান, ওই যুবকের ডান হাতের ঠিক নীচে গাড়ির মেঢেয় বন্দুকটি পড়ে ছিল। নিহত যুবকের ডান হাতে প্রচুর ‘গান পাউডার’ (গুলি চালানোর পর ওই চিহ্ন থাকে) লেগে ছিল। কেউ ডান হাতে বন্দুক ধরে নিজের বুকে গুলি চালালে যেখানে ক্ষতচিহ্ন হবে, এ ক্ষেত্রে সেখানেই হয়েছে। তা ছাড়া, বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল এবং যে কারণে ক্ষতের আশপাশেও প্রচুর গান পাউডার মিলেছে।
আরও খবর- ‘আক্রোশ থেকেই আক্রমণ’
তবে আত্মহত্যা করার জন্য ওই যুবক বন্দুক জোগাড় করল কী ভাবে?
এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘মানিকতলার ওই তল্লাটে বন্দুক পাওয়াটা জলভাত।’’
আর এখানেই ফের বেরিয়ে আসছে শহরের বুকে বেআইনি অস্ত্রের রমরমার বিষয়টি। সাম্প্রতিক কালে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার যতগুলি ঘটনা ঘটেছে, সেগুলির অধিকাংশই সার্ভিস রিভলভার বা বন্দুক দিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে। বেআইনি ওয়ান শটার দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা এই শহরে সাম্প্রতিক অতীতে হয়নি।
এর আগে দুষ্কৃতীরা অপরাধ করতে বেআইনি অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এ বার মুরারিপুকুরের ঘটনায় দেখা গেল, আত্মহত্যাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে বেআইনি অস্ত্র। পুলিশের দাবি, লালবাজারের কর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন, ভোটের আগে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নির্বাচন কমিশন চাপ দিলেও তা যে কথার কথা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে, সেটা ওই ঘটনায় ফের স্পষ্ট।