(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্তি পাণ্ডে, কুণাল ঘোষ। —ফাইল চিত্র।
উত্তর কলকাতা লোকসভায় তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ে মানিকতলার ভূমিকা ছিল ‘নগণ্য’। মাত্র সাড়ে তিন হাজার ভোট। শনিবার উপনির্বাচনের ফলঘোষণার পর দেখা গেল, সেই মানিকতলাতেই তৃণমূল প্রার্থী সুপ্তি পাণ্ডে জিতেছেন ৬২ হাজার ৩১২ ভোটে! প্রয়াত নেতা সাধন পাণ্ডের স্ত্রী সুপ্তির এই রেকর্ড জয়কে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসাবেই দেখছে তৃণমূল।
শাসকদলের শীর্ষ সারির নেতাদের বক্তব্য, বিবিধ কারণে মানিকতলায় তৃণমূল খুব একটা সুবিধাজনক জায়গায় ছিল না। তার কারণ যে তৃণমূলের স্থানীয় সমীকরণ, তা-ও বিলক্ষণ জানতেন মমতা। সেটা বুঝেই মানিকতলার ভোট নিয়ে কতগুলি পদক্ষেপ করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। প্রথমেই একটি ‘কোর কমিটি’ গড়ে দিয়েছিলেন। যার আহ্বায়ক করেন কুণাল ঘোষকে। কমিটিতে রাখা হয়েছিল কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ, বেলেঘাটার বিধায়ক পরেশ পাল, কলকাতার মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দারকেও। পাশাপাশিই, সুপ্তির নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অনিন্দ্য রাউতকে। তৃণমূলের বক্তব্য, মমতা যে ভাবে টিম সাজিয়েছিলেন, তাতেই সমস্ত নেতিবাচক সমীকরণ ভেস্তে গিয়েছিল।
উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে পরেশ, অতীন, অনিন্দ্যেরা যে পাণ্ডে পরিবারের বিরোধী, তা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। কৌশলে মমতা এই তিন জনকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুপ্তিকে জেতানোর। নবান্নে ডেকে বৈঠকও করেছিলেন। উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে প্রয়াত সাধনের সঙ্গে কুণালের যে সখ্য ছিল, তা-ও মমতার অজানা নয়। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, উপনির্বাচনে সেই সব পুরনো-নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ ধরেই ভোটের অঙ্ক কষেছিলেন দিদি।
শাসকদলের নেতৃত্বের বক্তব্য, মানিকতলায় তৃণমূলের মধ্যে চার ধরনের সমীকরণ ছিল। এক, একটি অংশ পাণ্ডে পরিবারের বিরোধী। দুই, একটি অংশ পুরোপুরি পাণ্ডে পরিবারের পক্ষে। তিন, দলে একটি অংশ রয়েছে, যারা সুপ্তির পক্ষে। চার, একটি অংশ ছিল সাধন এবং সুপ্তির কন্যা শ্রেয়া পাণ্ডের পক্ষে। শ্রেয়া যে বিধানসভায় প্রার্থী হতে আগ্রহী ছিলেন, তা মমতাও জানতেন। কিন্তু ভোটের অনেক আগে থেকেই কালীঘাটের ‘ঘনিষ্ঠ’ তৃণমূল নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন, শ্রেয়ার চলন-বলন, জীবনযাপন নিয়ে মমতা ক্ষুব্ধ। বড় কোনও মত পরিবর্তন না হলে দিদি তাঁকে প্রার্থী করবেন না। মমতা করেননি। উল্লেখ্য, মমতার সঙ্গে বিএড প্রশিক্ষণে সহপাঠী ছিলেন সুপ্তি। সে দিক থেকে সুপ্তিকে প্রার্থী করার বিষয়ে মমতার ‘আন্তরিক ইচ্ছা’ ছিল বলেই অভিমত অনেকের।
মমতার কৌশলের পাশাপাশি মানিকতলার উপনির্বাচনকে অনেকে কুণালের অগ্নিপরীক্ষা হিসাবেই বর্ণনা করছেন। দু’মাস আগে এই কুণালই ভোটের মধ্যে সুদীপ-বিরোধিতার স্বর চড়িয়ে শাস্তির মুখে পড়েছিলেন। দলের রাজ্য সম্পাদক এবং মুখপাত্র পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার বিবৃতি জারি করেছিলেন তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। কুণালকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফার ভোটের তারকা প্রচারকের তালিকা থেকেও। সেই পর্বে কুণালের এক্স (সাবেক টুইটার) বায়ো থেকে তৃণমূলের পরিচয় মুছে দেওয়া, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে গিয়ে ডেরেকের সঙ্গে কুণালের বৈঠক শাসকদলের মধ্যে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। তার পর অবশ্য কুণাল ক্রমে তৃণমূলের মূলস্রোতে ফেরার ধারাবাহিক প্রয়াস দেখিয়েছেন। সেই প্রয়াস যে খানিকটা সফল হয়েছিল, তার প্রমাণ মিলেছিল মমতা তাঁকে মানিকতলা উপনির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়ায়। মানিকতলার ভোটের জন্য কোর কমিটি গড়ে কুণালকে তার ‘আহ্বায়ক’ নিয়োগ করেছিলেন মমতা। তবে শুধু মানিকতলার ভোটের দায়িত্ব নয়। এর মধ্যে একাধিক সরকারি বিষয়েও মমতার বার্তাবাহক হিসাবে কুণাল বিবৃতি দিয়েছেন। সেটিও তৃণমূল তো বটেই, প্রশাসনেরও অনেকের কাছে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে হয়েছে। কুণালের অনুগামীদের বক্তব্য, তাঁদের ‘দাদা’ও মানিকতলাকে ‘মিশন’ হিসাবে নিয়েছিলেন। যে মিশনে রেকর্ড ভোটে জিতেছে তৃণমূল।
লোকসভা ভোটের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, মানিকতলার বিভিন্ন ওয়ার্ডে তৃণমূল পিছিয়ে। সাধন-সুপ্তির বাড়ি যে এলাকায়, সেই গোয়াবাগানেও বিজেপি এগিয়ে ছিল। কয়েকটি ওয়ার্ডে তৃণমূলের লিড ছিল যৎসামান্য। আবাসনগুলিতেও তৃণমূলের ফল ভাল হয়নি। কুণালেরা দায়িত্ব পেয়ে সেই ক্ষতেই প্রলেপ দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। এমনিতে উপনির্বাচনে শাসকদলের জেতাটাই রেওয়াজ। যদিও তার ব্যতিক্রমও ঘটে। তবে মানিকতলায় তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা ছিল দলের ভিতরের সমীকরণ।
কুণাল অবশ্য জয়ের পর মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি কৃতজ্ঞ যে, দিদি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। অভিষেকও আমায় নানা পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা পুরো তৃণমূল পরিবার ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করেছি।’’ উল্লেখ্য, ভোট মিটে গেলেও মানিকতলার কোর কমিটির এখনই অবলুপ্তি ঘটাচ্ছে না তৃণমূল। সূত্রের খবর, তৃণমূলের রাজ্য সংগঠনের সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বার্তা পাঠিয়েছেন, এই কমিটিই নতুন বিধায়ককে কাজে সাহায্য করবে। অনেকের মতে, ভোটের পরেও যাতে মানিকতলায় কোন্দল প্রকাশ্যে না চলে আসে, সেই কারণেই কুণাল, অতীন, পরেশদের এক মেরুতে রেখে দিতে চাইলেন মমতা।