ফাইল চিত্র।
রাজ্যে করোনায় মৃত্যু শূন্যে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি একটি করে হলেও, মৃত্যুর ঘটনা ফের সামনে আসছে। গত শনিবারই বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন করোনা আক্রান্ত এক তরুণী। সংক্রমণের লেখচিত্রও ওঠানামা করছে রাজ্যে। আর এই সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বিধিনিষেধ উঠে সব কিছু এখন যে ভাবে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে, তাতে যে কোনও সময়ে বিপর্যয় ঘুরে আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
তৃতীয় ঢেউয়ের পরে শেষ কয়েক মাস ধরে বঙ্গে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা একশোর নীচে। মৃতের সংখ্যা কমতে কমতে তা শূন্যে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও চিকিৎসকেরা সব সময়েই সতর্ক করে বলছেন, করোনা পুরোপুরি চলে যায়নি। তাই মাস্ক পরা, হাত ধোওয়া, ভিড় এড়িয়ে চলার মতো বিধি মানতেই হবে। অথচ, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। অধিকাংশ মানুষ নিজে
থেকেই মাস্ক পরা, জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধোওয়ার মতো অভ্যাস ত্যাগ করেছেন। রাস্তা বা গণপরিবহণ, সর্বত্র কার্যত ভিড়ে ঠাসাঠাসি ছবিটাই ফিরে এসেছে। যে ভিড়ে অধিকাংশের মুখে মাস্কের বালাই নেই। থাকলেও তা থুতনির নীচে।
রাজ্যের সংক্রমণ রোগ এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সকলেরই মতে, অতিমারির বিগত ঢেউগুলিতে দেখা গিয়েছে, মানুষ যখন একেবারে নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছেন তখনই নতুন একটি ঢেউ আছড়ে পড়েছে। সুতরাং নিজে থেকে আবার বিপদ ডেকে আনার আগে সরকার ও জনসাধারণ, উভয়কেই সতর্ক হতে হবে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪ জুন শনিবারের আগে গত ২৯ মে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার আগে ৬ মে মারা গিয়েছিলেন এক জন। এই ঘটনাক্রমই প্রমাণ করছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে আর কেউ মারা যাচ্ছেন না, এই ধারণা ঠিক নয়। স্বাস্থ্য শিবিরের পর্যবেক্ষণ, এঁদের প্রত্যেকেরই কোমর্বিডিটি ছিল। করোনাভাইরাস শরীরে ঢুকে সেই পুরনো রোগকেই আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘যাঁদের কোমর্বিডিটি রয়েছে, তাঁরা করোনা আক্রান্ত হলে ফল মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা সব সময়েই রয়েছে।’’
কিন্তু সাধারণ মানুষের একাংশ তা বুঝছেন না বলেই বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না বলে দাবি চিকিৎসক মহলের। তাঁরা জানাচ্ছেন, ধরা যাক, এক জন যুবক মাস্ক পরা বা হাত ধোওয়ার মতো নিয়ম মানছেন না। প্রতিদিন রাস্তায় ঘোরার ফলে তিনি করোনায় আক্রান্ত হলেন, কিন্তু উপসর্গহীন থাকলেন। এ বার ওই যুবকের বাড়িতে থাকা প্রবীণ মানুষটি তাঁর থেকে সংক্রমিত হলেন। আর পুরনো কোনও রোগ থাকায় হয়তো সেই সংক্রমণ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছল এবং ওই বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যুও হল। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের বক্ষরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরী বলেন, ‘‘বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই তা যেমন ঠিক, তেমনই কোভিড নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ভেবে সব বিধি উপেক্ষা করাও মূর্খামির পরিচয়। বঙ্গে চতুর্থ ঢেউ আসার যে সময় অনুমান করা হয়েছে, সেই সময় এখনও কিন্তু আসেনি। তাই নতুন বিপর্যয় যে আসবে না, সে কথা এখনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’’
চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, অনেক মানুষ করোনা পরীক্ষাও করাচ্ছেন না। জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসক কোভিড পরীক্ষার পরামর্শ দিলেও তা অগ্রাহ্য করছেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বলেন, ‘‘আপাতদৃষ্টিতে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা এখন অনেক কম। কিন্তু ভুললে চলবে না, মানুষও পরীক্ষা করাচ্ছেন কম। তাই প্রকৃত তথ্য জানতে হলে সেন্টিনেল সার্ভেল্যান্স এবং বেশি করে পরীক্ষার উপরেই জোর দিতে হবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, করোনা গোপনে কতটা প্রভাব ফেলছে জানতে সেন্টিনেল সার্ভেল্যান্স, প্রতি সপ্তাহে ব্লক এবং পুরসভা ভিত্তিক জ়োন তৈরি করে সমীক্ষা চালিয়ে সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নজরে রাখা হচ্ছে। এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের কথায়, ‘‘কোন কোন বিষয়ে এখন পরীক্ষা করা হবে, তা কেন্দ্রের তরফে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশি জরুরি নাগরিক সচেতনতা।’’ অথচ প্রতিদিন পথেঘাটে যে ভাবে ‘দায়িত্বজ্ঞান’-এর পরিচয় বড় অংশের মানুষ দিচ্ছেন, তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে চিকিৎসক মহল।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।