Pavlov Hospital

নিজভূমে ফিরে জমানো টাকায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন পাভলভের আবাসিকের

কাঁটাতারের কাছাকাছি সাদিকুলকে দেখে শুরু হয়েছিল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশ্নবাণ। উত্তরের বেশির ভাগই অসংলগ্ন ঠেকেছিল। এ হেন সাদিকুল পুলিশের হাত ঘুরে ২০১৫ সালে পৌঁছন কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালে।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০১
Share:

পাভলভের ধোবিঘরে কাজ করছেন সাদিকুল। —নিজস্ব চিত্র।

নিশ্চয়তা নেই, পরিবার ফিরিয়ে নেবে কি না। তবে, তা নিয়ে চিন্তিত নন তিনি। আপাতত চেনা মাটির গন্ধ আর বরবিলে চাষের স্মৃতি নিয়ে মশগুল বছর আটচল্লিশের শেখ সাদিকুল।

Advertisement

বাংলাদেশের দিনাজপুরের দোলুয়া গ্রাম ছেড়ে কী ভাবে পায়ে পায়ে কাঁটাতার পেরিয়েছিলেন? জিজ্ঞাসা করলে সাদিকুলের স্বীকারোক্তি, ‘‘আমার মাথায় গোলমাল ছিল। কী ভাবে এলাম, বলতে পারি না।’’ স্মৃতি হাতড়ে বলে চলেন, ‘‘দিনভর পথে পথে ঘুরতাম। লোকজন ধরে আমাকে খাইয়ে দিত। জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলতে পারতাম না।’’

কাঁটাতারের কাছাকাছি সাদিকুলকে দেখে শুরু হয়েছিল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশ্নবাণ। উত্তরের বেশির ভাগই অসংলগ্ন ঠেকেছিল। এ হেন সাদিকুল পুলিশের হাত ঘুরে ২০১৫ সালে পৌঁছন কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালে।

Advertisement

পাভলভ সূত্রের খবর, সাদিকুলকে কখনও হিংস্র হয়ে উঠতে দেখেননি কেউ। তবে তাঁর অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে চিকিৎসা শুরু হয়। পাভলভের খাতায়কলমে ‘সাইকোসিস’ লেখা সাদিকুল দ্রুত চিকিৎসায় সাড়া দিতে থাকেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অঞ্জলি’র তত্ত্বাবধানে ওই হাসপাতাল চত্বরেই শুরু হওয়া ধোবিঘরে ২০১৮ সালে যোগ দেন তিনি। সেই থেকে সেখানকারই কর্মী।

পাভলভ হাসপাতাল চত্বরের ধোবিঘরের প্রজেক্ট ম্যানেজার দেবারতি শাসমল কাজের সূত্রে সামনে থেকে দেখছেন সাদিকুলকে। দেবারতির কথায়, ‘‘সাদিকুলদার উপরে গোটা ধোবিঘর ইউনিট নির্ভরশীল। এখানে চারটি হাসপাতালের কাপড় ধোয়া হয়। সে সব আলাদা আলাদা ভাবে বাছাই, রং এবং লিনেন অনুযায়ী মেশিনে ধোয়া, সব শেষে নিখুঁত ভাঁজ করায় সকলকে সাদিকুলদা-ই প্রশিক্ষণ দেন বলতে গেলে। কাজের চাপ থাকলে ছুটির দিনেও চলে আসেন। কখনও বেহিসেবি খরচ করতে দেখিনি। অথচ, শরীর ঠিক রাখতে হিসাব করে নিজের টাকায় ফল কিনে খান।’’

সাদিকুল সম্পর্কে কথায় বার বার উঠে আসছিল তাঁর কাজের দক্ষতা ও সঞ্চয়ের মানসিকতার প্রসঙ্গ। ‘‘এক জন মানসিক রোগী সুস্থ হয়ে যে অন্যদের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপনে সক্ষম, তারই প্রমাণ সাদিকুল। যে কাজটাই করেন, অত্যন্ত যত্নে এবং নিখুঁত করেন। সেই সঙ্গে মিতব্যয়ী। যে কারণে শুধু ধোবিঘরে কাজ করেই দু’লক্ষ টাকা জমিয়েছেন। ওই টাকা নিয়ে যাবেন তিনি।’’— বলছিলেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া।

মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী রত্নাবলী রায় বলছেন, ‘‘আট বছর আগে ‘লন্ড্রি প্রজেক্ট’ বা ‘ধোবিঘর’ শুরুর উদ্দেশ্যই ছিল, শ্রমের বাজারের জন্য পাভলভের আবাসিকদের প্রস্তুত করা। পরিবার-পরিত্যক্ত হয়ে কাজের অভ্যাস ফিরিয়ে আনা দরকার ছিল। এমন প্রকল্পের প্রয়োজন তখন যে সকলে বুঝেছিলেন, তেমনটা নয়। তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের মতো কয়েক জন প্রকল্পটির সফল রূপায়ণে সক্রিয় ছিলেন। আজ হাসপাতালবাস শেষে কেউ বাড়ি ফিরে ধোবিঘরেই কাজ করেন, কেউ অন্য কাজে উপার্জন শুরু করছেন। সাদিকুলের মতো অনেকে এই কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করছেন। এটাই স্বস্তি দিচ্ছে যে, ওঁরা সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝছেন।’’

আপাতত সাদিকুলের অবশ্য একটাই প্রতীক্ষা— কবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তালিকায় তাঁর নাম উঠবে। বাড়ি থেকে যখন চলে আসেন, তখন ঘরে মা-বাবা আর
অবিবাহিত চার ভাই-বোন। এত বছর যোগাযোগ নেই। যদি গিয়ে দেখেন বাবা-মা নেই অথবা পরিবার মেনে নিতে চাইছে না, কী করবেন? সাদিকুলের জবাব, ‘‘এটা ভেবেই দেখিনি। তবে যা-ই হোক, নিজের টাকায় হাল কিনে বরবিলে চাষ করব। চাষবাস যে আমার রক্তে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement