গ্রিন করিডর করে বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতাল থেকে বাসুদেব দাস অধিকারীর (ইনসেটে) হৃৎপিণ্ড পৌঁছে দেওয়া হল হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
পথ দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়েছিলেন এক যুবক। উন্নত চিকিৎসা পেতে গ্রাম থেকে শহরের বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন বাবা। কিন্তু এক দিন পরেই ছেলের ব্রেন ডেথ ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেও পরক্ষণেই ওই ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেন অঙ্গদানের। চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিনি জানিয়ে দেন, ‘‘আমার ছেলে তো চলেই গেল। ওর অঙ্গ পেয়ে বরং অন্য ছেলেমেয়েরা বাঁচুক। ওদের মধ্যেই আমার ছেলে বেঁচে থাকবে।’’ এর পরেই ওই যুবকের হৃৎপিণ্ড, লিভার, কিডনি দানের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের নাসরা গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় চাষি শুকদেব দাস অধিকারীর একমাত্র ছেলে বাসুদেব দাস অধিকারী (২২)। পড়াশোনা শেষ করে বাবার সঙ্গেই চাষের কাজ করতেন। তাঁর পরিজনেরা জানান, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে পাশের এলাকাতেই জলসা দেখতে গিয়েছিলেন বাসুদেব। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ সেখান থেকে বাইক চালিয়ে ফেরার পথে বাড়ি থেকে কিছু দূরে দুর্ঘটনা ঘটে। মাথায় চোট লাগে যুবকের। তাঁর জেঠতুতো দাদা নন্দ বলেন, ‘‘রাতেই ভাইকে সবং গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরদিন সকালে মেদিনীপুরে নিয়ে ওঁর মাথার সিটি স্ক্যান করা হয়। আরও ভাল চিকিৎসার জন্য কলকাতার অ্যাপোলোয় নিয়ে যাই।’’
২৮ ফেব্রুয়ারি বাইপাসের ধারের ওই হাসপাতালে ভর্তি হন বাসুদেব। ১ মার্চ চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, তাঁর ব্রেন ডেথ হয়েছে। নন্দ বলেন, ‘‘ভাইয়ের ব্রেন ডেথ হয়েছে শুনেই বুঝতে পারি ও আর বাঁচবে না। তখন ভাবি, ওর শরীরে যে অঙ্গগুলি সতেজ রয়েছে, সেগুলি যদি অন্যদের কাজে লাগে। কাকাকে বলতে তিনিও সম্মতি দেন।’’ পরিজনদের থেকে সম্মতি মেলার পরেই ওই হাসপাতালের তরফে বিষয়টি জানানো হয় ‘রিজিয়োনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশন’-এ (রোটো)।
রোটোর যুগ্ম অধিকর্তা, চিকিৎসক অর্পিতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এই সব ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। যে অনুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ওঁদের মধ্যে দেখা গিয়েছে, তা সকলের থাকে না। তাই ওই যুবকের পরিবারের সিদ্ধান্ত শিক্ষণীয় ও প্রশংসার।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শহরের শিক্ষিত মানুষকেও অঙ্গদানের বিষয়ে অনেক বোঝাতে হয়। অনুরোধ করা হলেও, অনেকেই তা রাখেন না।’’
রোটো-র তরফে জানা গিয়েছে, বাসুদেবের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে হাওড়ার নারায়ণা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি ১৩ বছরের এক বালকের শরীরে। হৃৎপিণ্ডের ভাল্ভে জন্মগত ত্রুটি ছিল তার। বাসুদেবের একটি কিডনি পেয়েছেন এসএসকেএমের এক তরুণী। অন্য কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে অ্যাপোলোয় ভর্তি পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দা ২৩ বছরের এক যুবকের শরীরে। ওই হাসপাতালেই নদিয়ার বাসিন্দা ৫৫ বছরের প্রৌঢ়কে দেওয়া হয়েছে লিভার।
এ দিন সকালে বাসুদেবের শরীর থেকে ওই অঙ্গগুলি বার করার প্রক্রিয়া শুরু করেন চিকিৎসকেরা। বাইপাসের ওই হাসপাতাল থেকে এসএসকেএম এবং হাওড়ার বেসরকারি হাসপাতালে অঙ্গ পৌঁছতে গোটা রাস্তা গ্রিন করিডর করা হয়। বিকেল চারটের সময়ে অঙ্গ নিয়ে রওনা দিয়ে ৪টে ১৬ মিনিটে হাওড়ায় পৌঁছে যায় হৃৎপিণ্ড। ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, গত ১৭ অগস্ট সেখানেই এক বালকের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এ দিন দ্বিতীয় বার হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হল কোনও বালকের শরীরে। যা পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় পেডিয়াট্রিক হার্ট প্রতিস্থাপন।