পথে না বেরোনোই একমাত্র পথ সদ্য মায়েদের?

অভিলাষা যেমন বললেন, ‘‘ডাক্তারের ক্লিনিকে আগে অনেক বার বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছি। অসুবিধা হয়নি। ওই মল-এও ব্যবস্থা থাকবে, এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু যা অভিজ্ঞতা হল, আর কখনও ওখানে যাব না। যেখানে এই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেই শুধু যাব।’’ 

Advertisement

অন্বেষা দত্ত

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৮ ০১:১৮
Share:

বালির রঙ্গোলি মলে স্তন্যদান ও ডায়াপার বদলানোর ঘর। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পরে নতুন মায়েদের কি বাড়িতে বসে থাকাই একমাত্র পথ? কারণ যে মুহূর্তে কোলের শিশুকে নিয়ে শহরের পথে পা রাখবেন তাঁরা, তখনই মাথায় আসবে একরাশ চিন্তা— সন্তানের খিদে পেলে কোথায় ওকে দুধ খাওয়াতে পারব? দিন কয়েক আগে ঠিক এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই সাউথ সিটি মলের কর্মীদের তরফে যে ধরনের উত্তর পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অভিলাষা দাস অধিকারী নামে এক তরুণী, তাতে স্তম্ভিত গোটা শহর। সব জায়গায় শৌচাগারের মতোই স্তন্যপান করানোর ঘর থাকাও যে একটা অতি আবশ্যিক ব্যাপার, সে চিন্তাই এখনও অধিকাংশ মানুষের ভাবনায় আসে না। আর আসে না বলেই এত জটিলতা, এত রকম বাধা।

Advertisement

অভিলাষা যেমন বললেন, ‘‘ডাক্তারের ক্লিনিকে আগে অনেক বার বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছি। অসুবিধা হয়নি। ওই মল-এও ব্যবস্থা থাকবে, এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু যা অভিজ্ঞতা হল, আর কখনও ওখানে যাব না। যেখানে এই ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানেই শুধু যাব।’’

গ্রাম থেকে আসা কোনও মহিলা লোকাল ট্রেন-মেট্রোয় অথবা বাসে স্বচ্ছন্দে আঁচল চাপা দিয়ে স্তন্যপান করালে সে ভাবে আপত্তির আঙুল উঠতে দেখা যায় না। তবে হঠাৎ শহুরে মহিলা একই কাজ করায় কেন এত চোখে লাগল?

Advertisement

অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘এটা যে ভীষণ স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, সেটাই কেউ বুঝতে চান না। দেশের বাইরে গিয়ে কিন্তু আমরা সব ধরনের সুবিধা পাই। শুধু কলকাতাতেই এমন! ফিডিং রুমের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে এ শহরের আরও কত যুগ লাগবে, জানি না।’’ তিনি নিজে কি এমন অসুবিধের মুখোমুখি

হয়েছেন কখনও? ‘‘সৌভাগ্যবশত না। আমার গাড়ি আছে। বাড়ির আশপাশে শপিং মল-ও রয়েছে। বাচ্চা নিয়ে কোথাও গেলেও অনেকে আমাকে বাড়তি সুবিধা দেন, সেলিব্রিটি হওয়ার সুবাদে। কিন্তু আর পাঁচ জনের ক্ষেত্রে সেটা তো হয় না। যে কোনও বিল্ডিং তৈরির আগে প্ল্যানিংয়েই কেন এটা থাকবে না?’’

তরুণ অভিনেতা অর্জুন চক্রবর্তীর স্ত্রী সৃজাও নতুন মায়েদের এক জন। তিনি বললেন, ‘‘এ শহরে যতটুকু যা আছে, সেগুলোকে ঠিক ফিডিং রুমও বলা যায় না। সেগুলো শুধু চেঞ্জিং রুম, বাচ্চার ডায়াপার বদলানোর জায়গা। সেখানে সব সময়ে বসার জায়গাও থাকে না।’’ সৃজা এও বলেন, ‘‘বাচ্চা যখন কেবলমাত্র মায়ের দুধের উপরেই নির্ভরশীল, সেই সময়ে পাম্প করে দুধ ভরে নিয়ে যেতাম বোতলে, কারণ জানতাম কোথাও ঠিকমতো ওকে খাওয়াতে পারব না।’’

মাত্র ১৯ দিন হল মা হয়েছেন আর এক অভিনেত্রী সুদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে না বেরোলেও তিনি এমন পরিস্থিতির কথা জেনে উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু আইন করে একটা ঘর রেখে দিলেই কিন্তু দায় ফুরিয়ে যায় না। সেই ঘরে যথাযথ সব কিছু রাখা হচ্ছে কি না, তাও দেখা দরকার। সবচেয়ে বেশি জরুরি, মায়েদের প্রতি সহমর্মিতা। যেটা একেবারেই নেই এখন। সদ্যোজাতকে খাওয়ানোর দরকার পড়লে আর কোনও মা যেন এমন অমানবিক আচরণের সম্মুখীন না হন, সেটা দেখা জরুরি।’’

শিশুকে সঙ্গে নিয়ে অনেক সময়েই মা-কে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। সেই সব চেম্বারেও কি বিষয়টি মাথায় রাখা হয়? শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানালেন, তাঁর চেম্বারে এমন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অনেক চেম্বারে তা নেই, এটাই বাস্তব। ওই শপিং মলে যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে মত অপূর্ববাবুর। তিনি বললেন, চিকিৎসকের চেম্বার-সহ সব জায়গায় ফিডিং রুমের ব্যবস্থা রাখা উচিত। তাঁর মতে, “ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন অনুযায়ী চেম্বারে কী কী থাকা উচিত, তা খতিয়ে দেখার কথা। ফিডিং রুম আছে কি না, তাও অবশ্যই দেখা উচিত।”

প্রসবের পরে কোনও জটিলতা তৈরি হলে মাকে যেতে হতে পারে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে এই ব্যবস্থা থাকলেও আর যে সব জায়গায় তিনি বসেন, সেখানে ব্যবস্থা নেই। অভিনিবেশবাবুও মনে করেন, বিদেশের মতো এখানেও ফিডিং রুমের ব্যবস্থা আবশ্যিক করা উচিত।

পূর্ব রেলওয়ের জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র জানালেন, হাওড়া, শিয়ালদহ, বর্ধমান, আসানসোল, মালদহের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে ফি়ডিং রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে গত বছর থেকে। আরও বেশ কিছু বড় স্টেশনে এই ব্যবস্থা রাখার কখা ভাবছেন তাঁরা। দক্ষিণ-পূর্ব রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, সেখানকার সব ব়ড় স্টেশনে এর জন্য আলাদা বুথ করা রয়েছে। রয়েছে বেবি ফুডের কাউন্টারও।

কিছু শপিং মল, পাসপোর্ট অফিস, বিমানবন্দর, মার্কিন কনসুলেটে ফিডিং রুম থাকলেও নেই-এর ভাঁড়ারটা কম নয়। কলকাতা মেট্রো রেলের জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মেট্রোয় দ্রুত যাতায়াত বলে আমরা স্টেশনে বসতে দিতেও উৎসাহ দিই না। দু’টো স্টেশনের দূরত্ব কম। তাই ফিডিং রুমের ভাবনা সে ভাবে নেই। শৌচাগারও খুব কম স্টেশনে আছে।’’ কিন্তু কখনও প্রয়োজন পড়লে? ‘‘স্টেশন মাস্টারের ঘরে ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে,’’ মন্তব্য ইন্দ্রাণীদেবীর।

রাজ্য পরিবহণ সংস্থার তরফে নারায়ণস্বরূপ নিগম জানালেন, শহরের লম্বা রুটের গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ডেও সে ভাবে ফিডিং রুমের ব্যবস্থা নেই। তাঁর দাবি, ‘‘ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডে ছড়ানো অনেকটা জায়গা। ওখানে কিছু তৈরি করাই মুশকিল। তবে বিধাননগরের করুণাময়ীয়ে নিরাপদ আলাদা জায়গা আছে, যেটা চাইলে ব্যবহার করা যায়। তবে ফিডিং রুম হিসেবে সেখানেও কিছু তৈরি করা নেই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement