Pot Art

কাঠখোদাই, পটে শিল্প-অধিষ্ঠান

কলকাতার বটতলা, গরানহাটা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাঠখোদাই চিত্রের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের দুর্গাপুজোর আরও গভীর একটা সম্পর্ক আছে।

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৫১
Share:

—ফাইল চিত্র।

কথায় বলে ‘রথ টানলে দুর্গা আসে’। প্রবাদের যাথার্থ্য বোঝা যায় অনেক সাবেক পুজোর ক্ষেত্রে, রথযাত্রার দিন দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় যে! আবার উনিশ শতকে কলকাতার সিমলেপাড়ার কাঠখোদাই শিল্পী রামধন কর্মকারের করা ছাপচিত্রের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের গঠন আকৃতি ও পঞ্চরত্ন চূড়ার সঙ্গে তার গঠনগত মিল। তবে কলকাতার বটতলা, গরানহাটা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাঠখোদাই চিত্রের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের দুর্গাপুজোর আরও গভীর একটা সম্পর্ক আছে। একমাত্র ধনীগৃহে পূজিতা দুর্গাকে সর্বজনের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজে কথকতা, পাঁচালি, পটের ছবির পাশাপাশি কাঠখোদাইয়ের ছাপচিত্রের বড় একটা ভূমিকা ছিল। এই পদ্ধতিতে ছাপা, সুলভ মূল্যের ছবির মাধ্যমেই দুর্গা-সহ অন্যান্য দেবদেবীর ছবি আবাহন-বিসর্জনের চক্র ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে জায়গা পেল।

Advertisement

বাঙালির দুর্গাপুজোর প্রধান ভরকেন্দ্র কলকাতা, তা বলে শিল্প-ঐতিহ্যের ইতিহাসে কলকাতাই সব নয়। প্রাচীনকাল থেকেই শক্তি ও তন্ত্র উপাসনার উত্তরাধিকার লালন করে আসছে আরও নানা অঞ্চল, জেলা, গ্রাম। বীরভূমের হাটসেরান্দি যেমন। প্রান্তিক এই গ্রামে প্রতিটি বাড়ি ও আটচালায় রীতি মেনে প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজন, পটে আঁকা শিল্প-ঐতিহ্যে। ধনী বাবুদের করায়ত্ত দুর্গোৎসবের বিপরীতে হাটসেরান্দি ও তার আশপাশের গ্রামের শিল্পীদের পটে আঁকা দুর্গার আবাহন বাস্তবেই সর্বজনের উৎসব। কলকাতার সৌভাগ্য বলতে হবে, এক দিকে বীরভূমের হাটসেরান্দির পট, অন্য দিকে উনিশ শতকীয় নগরকেন্দ্রিক কাঠখোদাই ছবি, দুই-ই এ বার সে দেখতে পাবে পুজোয়। শিল্পী পার্থ দাশগুপ্তের পরিকল্পনায় এ বছর হালতু রামলাল বাজারের পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘের শারদভাবনা ‘সর্বজনের দুর্গাপুজো’, এই দুই পরম্পরার সংযোগস্থাপনে প্রয়াসী।

বাঁশ চট মাটির প্রলেপ দেওয়া কাঠামোর উপরে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে, পূর্বজদের শিক্ষা মেনে চালচিত্র আঁকেন পটশিল্পী রামকৃষ্ণ সূত্রধর, পেশায় যিনি টোটোচালক! শিল্পীর আঁকা পটে নিহিত হাটসেরান্দি গ্রামের সূত্রধর সম্প্রদায়ের দুর্গাপট আঁকার প্রায় দু’শো বছরের ইতিহাস। লোহার স্তম্ভের গায়ে রামকৃষ্ণ রাজীব আদরগোপাল সূত্রধরদের আঁকা পটের ‘ট্রান্সলিট প্রিন্ট’কে (ছবিতে নীচে) ব্যবহার করা হয়েছে মণ্ডপসজ্জায়। আবার মধ্য কলকাতার রামবাগানের সুদীপ্ত মাইতি ও সহযোগী শিল্পীদের হাতে দ্বিমাত্রিক কাঠখোদাই ছবির রূপান্তর হচ্ছে ত্রিমাত্রিক শিল্পভাবনায়। পুরনো পঞ্জিকায় ছাপা রথ, গণপতি, নৃত্যরতা রমণী এ বার রূপ পেয়েছে বাঁশের কারুকাজে (ছবিতে), উনিশ শতকের কাঠখোদাইয়ের নির্যাস শিল্পীরা তুলে আনছেন এই মাধ্যমে। শিল্পরূপিণীর প্রকৃত অধিষ্ঠান যে সর্বজনের মাঝে, তা-ই মনে করিয়ে দেয় অনন্য এই শিল্পভাবনা।

Advertisement

কী দিয়ে

দুধ-চায়ের চল এখন অনেক বাড়িতেই কমছে ধীরে ধীরে। অথচ তাঁর দরকার ছিল ওই গুঁড়ো চা-পাতাই, চা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর। বনহুগলির ৭৭/৫ রাইমোহন ব্যানার্জি রোডের হরিসাধন বিশ্বাস ফি-বছর একটি ছোট্ট ঠাকুর গড়েন, এক-এক বার এক-একটি উপকরণ দিয়ে। এ ভাবেই আগে আগে আটা, পেঁয়াজ ও রসুনের খোসা, ফুলের পাপড়ি, বীজ, তেজপাতা, গেঞ্জি-কাপড়, তার, পাইপের টুকরো তাঁর হাতে রূপ পেয়েছে অপরূপা দশভুজায়। পুজো আসার ঢের আগে থেকে তিনি ভাবতে আর খুঁজতে শুরু করেন, কী দিয়ে ‘ঠাকুর গড়া’ যায়। এ বছর প্রায় মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল পরীক্ষানিরীক্ষা: ব্যবহৃত গুঁড়ো চা-পাতা ভাল করে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে, ফের মিহি করে নিয়ে তার পর আঠা মেশানো, তারও পরে নানা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে সার্থকতায় পৌঁছনো। সাড়ে সাত ইঞ্চির দুর্গাপ্রতিমা, লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ কার্তিক মহিষ বাহনাদি-সহ। দেখে কে বুঝবে, গুঁড়ো চায়ের!

ভারতপথিক

সার্ধদ্বিশতজন্মবর্ষে নব মূল্যায়ন রাজা রামমোহন রায়ের জীবনকৃতির। এই ফিরে দেখার সূত্রেই সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতা আয়োজন করেছিল বক্তৃতামালা, দেশ-বিদেশের রামমোহন-চিন্তকদের অংশগ্রহণে। এই বক্তৃতামালা বাংলায় অনুবাদ করে, এবং তার সঙ্গে বাংলার আরও কয়েকজন রামমোহন-গবেষকের লেখা যুক্ত করে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশ করল বই, কাল ও কালান্তরের পথিক রামমোহন রায় (সম্পা: রোসিঙ্কা চৌধুরী)। সঙ্কলনটি সমৃদ্ধ ব্রায়ান এ হ্যাচার গৌতম ভদ্র লিন জাস্টুপিল ডারমট কিলিংলে তনিকা সরকার প্রমুখের লেখায়, মুখবন্ধ দীপেশ চক্রবর্তীর। গত ৭ অক্টোবর মেদিনীপুরে জঙ্গলমহল সাহিত্য উৎসবে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল, সেই সঙ্গে বাংলা আকাদেমির রবীন্দ্র রচনাবলী ২১তম খণ্ডটিও।

ছোটদের জন্য

ইরানের শিক্ষক, লেখক, বামপন্থী সমাজকর্মী সামাদ বেহরঙ্গীর ছোটো কালো মাছ নামের ছোটদের বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল শাহের ইরানে। সেই গল্প নিয়েই পূর্ব কলকাতা বিদূষক নাট্যমণ্ডলীর ছোটদের নাটক, কালো মাছের গল্প। আর এক শিক্ষক, স্বাধীনতা সংগ্রামী মাস্টারদা সূর্য সেনের জীবন নিয়ে বেদব্রত পাইনের ছবি চিটাগং তো বিখ্যাত। পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ-এর ‘ছোটদের সিনেমা, ছোটদের থিয়েটার’ অনুষ্ঠানে মিলেমিশে যাবে এই দুই শিক্ষকের গল্প। এ ছাড়াও গানে রাকা-বিভুব্রত; রোকেয়া রঙমশাল-এর খুদে সদস্যদের অভিনয়ে বাদল সরকারের নাটক হট্টমালার ওপারে। এত আয়োজন খুদে দর্শকদের জন্য, ১৫ অক্টোবর হাজরা মোড়ের কাছে সুজাতা সদনে, দুপুর ২টো থেকে সন্ধে ৭টা।

অভিনব

মানুষ যুগে যুগে নিজের শরীরে ট্যাটু বা উল্কি আঁকিয়েছে। কখনও সামাজিক পদমর্যাদার চিহ্ন হিসাবে, কখনও ভালবাসার প্রকাশ রূপে, আবার কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসে। পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মানুষের শরীরে উল্কির নমুনা পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে কিছু জনগোষ্ঠীর নানা আচারব্যবস্থার মধ্যে উল্কি সীমাবদ্ধ থাকলেও, গত শতাব্দী থেকে মূল ধারার সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে নিজের শরীরে পছন্দের উল্কি আঁকিয়ে নেওয়া। শরীরকে ক্যানভাস বানিয়ে আঁকা হচ্ছে নানা আকর্ষণীয় নকশা। এ শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর, ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান ক্লাবে হচ্ছে ‘কলকাতা ট্যাটু ফেস্টিভ্যাল’, যোগ দেবেন দেশ-বিদেশের বিখ্যাত উল্কি শিল্পীরা। থাকছে গানবাজনা খাওয়াদাওয়া, ‘আর্টিস্টস’ রিট্রিট’— অনেক কিছু।

স্মরণে

উপহার পাওয়া ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু, উদয়ের পথে ছবির শুটিং দেখে প্রবল হয় সিনেমায় ক্যামেরাম্যান হওয়ার ইচ্ছে। রামানন্দ সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিচয়, ক্রমে জি কে মেহতা অজয় কর অনিল গুপ্ত দীনেন গুপ্ত ও সুব্রত মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ; সত্যজিৎ রায় পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়েন সৌম্যেন্দু রায়। রবীন্দ্রনাথ, তিন কন্যা-য় যে যাত্রা শুরু, তা পূর্ণতা পেয়েছে সত্যজিৎ-সহ বহু পরিচালকের ভাবনার শিল্পিত রূপদানে। সৌম্যেন্দু রায় স্মরণে চিত্রবাণী ও জীবনস্মৃতি আর্কাইভের উদ্যোগে গত ৭ অক্টোবর চিত্রবাণীতে একত্র হয়েছিলেন বিশিষ্টজন; দেখানো হল অরিন্দম সাহা সরদারের তথ্যচিত্র সৌম্যেন্দু রায়। এখন সত্যজিৎ পত্রিকার উদ্যোগে আর একটি অনুষ্ঠান ১৭ অক্টোবর বিকেল ৫টায় নন্দন-৩’এ, থাকবেন বরুণ চন্দ উৎপলেন্দু চক্রবর্তী প্রসাদরঞ্জন রায় গৌতম ঘোষ প্রমুখ।

লোকশিল্পে তিনি

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতশিল্পের অন্তরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রূপ এবং রূপাতীতের মিলনমাধুরী। বাংলার লোকশিল্পের অন্দরে তার অস্তিত্ব বহতা আজও। পল্লিবাংলার মানুষের সরল জীবনের ছন্দে, সহজ রেখায়-রঙে সৃজনের যে আনন্দ-উৎসব, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘উদ্বোধন কার্যালয়’ মহালয়ায় প্রকাশ করতে চলেছে তাহেরপুরের লক্ষ্মীসরা কেন্দ্রিক নোটবুক, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস সমন্বিত বুকমার্ক সেট এবং ‘বাংলার লোকশিল্পে শ্রীরামকৃষ্ণ’ বিষয় অবলম্বনে চিত্রিত রঙিন ক্যালেন্ডার। পূর্ববঙ্গে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাহেরপুরের লক্ষ্মীসরা বাংলার অন্যতম লোকজ সম্পদ। অন্য দিকে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের পোষণায় ওড়িয়া ও মোগল তাসের সম্মিলনে জন্ম দশাবতার তাসের, এখন শৌখিন শিল্পকর্মমাত্র। ক্যালেন্ডারে মিশেছে নয়া পিংলা ও কালীঘাট পটচিত্রে, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলে, বাংলার চালচিত্রে রামকৃষ্ণময় নবনির্মাণ (ছবি): লোকশিল্পী ও এই প্রজন্মের চারুশিল্পীদের শ্রমে, যত্নে।

নতুন শুরু

পুজো এসে গেল। উৎসবের অন্যতম উপচার শারদ সাহিত্য, এই বছর তাতে শামিল ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’-ও, অন্য রকম এক ভাবনা নিয়ে। শহর কলকাতার কোনও শিল্প প্রদর্শশালা থেকে শারদীয়া পত্রিকার প্রকাশই এক অন্যতর ভাবনা। চিত্রকলা ও বই নিয়ে দেবভাষা-র সংসার, শারদ পত্রিকায় শিল্প ও সাহিত্য হাত ধরেছে বঙ্গসংস্কৃতির অন্য ক্ষেত্রগুলিরও। আজ, ১৪ অক্টোবর মহালয়ার দিনে তার আত্মপ্রকাশ, তবে প্রকাশ উৎসবের পথটিও অভিনব। যামিনী রায় অতুল বসু হরেন দাস সোমনাথ হোর রেবা হোর সনৎ কর রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় গণেশ হালুই লালুপ্রসাদ শ আর যোগেন চৌধুরীর শিল্পকৃতি নিয়ে সাজানো প্রদর্শনী ‘মায়েস্ত্রো’-র শুরু আজ, সেই আবহেই প্রথম শারদীয়া পত্রিকারও (ছবি প্রচ্ছদ থেকে) উদ্বোধন। প্রদর্শনী চলবে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত, রবিবার বাদে— দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা।

নিয়ম-অনিয়ম

বাংলার জেলগুলিতে কারারক্ষী-সহ অধস্তন কর্মচারীদের কাজ করতে হয় বিপুল ‘স্ট্রেস’-এ, তার জের এসে পড়ে বিচারাধীন বন্দিদের উপর। রাষ্ট্রের দ্বারা নিপীড়িত হন বলেই জেলের কারারক্ষীও নিপীড়ক হয়ে ওঠেন। পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মচারী নেই, চার জনের কাজের চাপ বইতে হয় এক জনকে, এরই ফাঁকে তৈরি হয় নিয়ম-বহির্ভূত পীড়ন, দুর্নীতি। লকআপে নগ্ন করে তল্লাশি, বন্দিদের হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে সেপাই-জমাদারদের লাঠির ছোঁয়া সওয়া, এই সবই ‘নিয়ম’: ‘সংশোধনাগার’ চলে ‘কারাগার’-এর নিয়মেই। আজও বছরের পর বছর বিনা বিচারে দমনমূলক আইনে আটকে রাখা হয় রাজনৈতিক বন্দিদের। ‘কারাগার থেকে সংশোধনাগার: এক রাজনৈতিক বন্দির অভিজ্ঞতায়’ শীর্ষক আলোচনায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বললেন অনুপ রায়, বিভিন্ন পর্যায়ে জীবনের পঁচিশ বছর যাঁর কেটেছে রাষ্ট্রের বন্দিশালায়। ঈক্ষণ পত্রিকার আয়োজনে, মহাবোধি সোসাইটিতে গত ২ অক্টোবর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement