প্রতীকী ছবি।
দেরি হয়ে যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালেই। শিশুদের হৃদ্যন্ত্র সংক্রান্ত জন্মগত সমস্যার চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারে দেরি কমাতে শুরু হয়েছিল ‘শিশু সাথী’ প্রকল্প। কিন্তু কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজের হৃদ্রোগ চিকিৎসকদের অভিযোগ, পরিকাঠামোর শোচনীয় হালের কারণে ও সরকারি নিয়মের ফাঁসে আটকে শিশু সাথী প্রকল্পের আওতায় অস্ত্রোপচারে মাসের পর মাস দেরি হচ্ছে। তাতে অপেক্ষায় থাকা কোনও কোনও শিশু চিকিৎসা না পেয়ে মারাও যাচ্ছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর এ রাজ্যে প্রায় ১২ হাজার শিশু হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা নিয়ে জন্মায়। তাদের মধ্যে প্রায় দু’হাজার শিশুর অবস্থা হয় গুরুতর। তাই বছরে অন্তত এই ধরনের তিন হাজার শিশুর দ্রুত অস্ত্রোপচারের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ‘শিশু সাথী’ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কিছুই।
২০২১ সালের সরকারি হিসাব বলছে, সে বছর রাজ্যের সরকারি ক্ষেত্রে ‘শিশু সাথী’ প্রকল্পে মাত্র ২০০-২৫০ জনের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে হয়েছে মেরেকেটে ৪০০ জনের। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০২১ সালে এমন অস্ত্রোপচার হয়েছিল মাত্র ৫২টি। ২০২২ সালে সেখানে প্রায় ৩০২ জন শিশু এই প্রকল্পে চিকিৎসা করাতে এসেছিল। তাদের মধ্যে মাত্র ৭১ জনের অস্ত্রোপচার হয়।
রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমে ২০২১ সালে৩৩৪টি শিশুর নাম পরিষেবার জন্য নথিভুক্ত হয়। কিন্তু মাত্র ৮৯ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়। ২০২২সালে এসএসকেএমে অস্ত্রোপচারের জন্য নাম নথিভুক্ত হয় ৫৮৫টি শিশুর। কিন্তু অস্ত্রোপচার করা হয় মাত্র ১১১ জনের।
বাকি শিশুদের তা হলে কী হয়?
এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিয়োথোরাসিক বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসক বললেন, ‘‘হয়তারা আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগে মাসের পর মাস ঘুরতে থাকে। তার পরে এক দিন উধাও হয়ে যায়। নয়তো সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কোনও বেসরকারি হাসপাতালে যায়। সেখানেও সময়মতো ভর্তি হতে পারে না বেশির ভাগই। অপেক্ষা করতে গিয়েমারা যায় অনেক শিশু।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শিশু সাথীতে প্রতি মাসে যত রোগী আমরা পাই, তারদুই-তৃতীয়াংশেরই অস্ত্রোপচার করতে পারি না।’’
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, আর জি কর—সব জায়গারই চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের অস্ত্রোপচারের আলাদা অপারেশন থিয়েটার, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মীর দল এবংঅস্ত্রোপচার-পরবর্তী যত্নের আলাদা ইউনিট না থাকলে কখনওই অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়ানো বা অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা কমানো যাবে না। আর জি কর এবংকলকাতা মেডিক্যালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, চিকিৎসক সুদীপ্ত রায় সমস্যার কথা স্বীকার করে বললেন, ‘‘যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে আর জি কর এবংকলকাতা মেডিক্যালের মতো হাসপাতালে শিশু সাথীর জটিল অস্ত্রোপচার কার্যত হচ্ছেই না। বেসরকারি জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে। তাই দ্রুত এই রকম আলাদাইউনিট এবং অপারেশন থিয়েটার তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
বেসরকারি হাসপাতালগুলির আবার অভিযোগ, তারাসরকারি জায়গার তুলনায় অনেক বেশি শিশু সাথীর অস্ত্রোপচার করছে। কিন্তু, সরকার তাদের ৩০ শতাংশ টাকা কেটে নিচ্ছে, ‘রেট’ অত্যন্ত কম রেখেছে এবং সেটাও সময়মতো দিচ্ছে না। এতে তারা শিশুসাথী প্রকল্পে রোগী ভর্তি নেওয়ার উৎসাহ হারাচ্ছে।
তাদের আরও দাবি, সরকারি নীতির জন্যই শিশুসাথীর অস্ত্রোপচারে দেরি হচ্ছে। কারণ, আগে জেলা থেকে সরাসরি শিশু সাথীর রোগীরা চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালে চলে আসত। কিন্তু, পরিবর্তিত নিয়মে তাদের আগে কোনও একটি সরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। সেই হাসপাতাল অপেক্ষাকৃত কম গুরুতররোগীদের নিজেদের কাছে রেখে জটিল সমস্যাযুক্তদের বেসরকারি জায়গায় ‘রেফার’ করে। তাতে দেরিও হয়।
অনেক ক্ষেত্রে আবার উন্নতচিকিৎসা সামগ্রী ও যন্ত্রের দরকার হয়। তার জন্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে টাকা চেয়ে আলাদা আবেদন করতে হয়। সেই অনুমোদন আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। তাতেও অস্ত্রোপচারে বিলম্ব হয়। যেমন, বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এই বিশেষ অনুমোদন সময়মতো আসেনি বলে ২০২২ সালে ১৪টি শিশুর অস্ত্রোপচার ঝুলে ছিল।