সিন্ডিকেটের প্রভাবে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের ফুটপাত জুড়ে পড়ে নির্মাণ সামগ্রী। অবৈধ পার্কিংয়ের চোটে রাস্তা দিয়েও হাঁটার জো নেই। নিজস্ব চিত্র।
ঘটনা ১: সকাল ৯টার ব্রাইট স্ট্রিট। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে পর পর দুটো গুলির আওয়াজ। যাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল, তাঁর গায়ে গুলি না লাগলেও তিনি রাস্তায় পড়ে গিয়েছেন। সেখানেই তাঁকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছে তিন জন। পাশেই পড়ে একটি মোটরবাইক, রক্তে ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। এই ঘটনাক্রম এর পরে চলল রাত পর্যন্ত। ইটবৃষ্টি, গুলি, বোমাবাজির শেষে পুলিশ গ্রেফতার করল কয়েক জনকে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় বরাতজোরে বেঁচে গেলেন অস্ত্রের কোপ খাওয়া ব্যক্তি। তদন্তে উঠে এল, আদতে এই ঘটনা একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির দখল নিয়ে দুই সিন্ডিকেটের লড়াইয়ের ফল!
ঘটনা ২: প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের বড়বাগান বস্তির একটি বাজারে হঠাৎ একের পর এক দোকানে ভাঙচুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই চড়াও হল আর এক দল। শুরু হল হাতাহাতি, ইট ছোড়া, বোমাবাজি। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়েও গল্ফ গ্রিন থানার পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় চারু মার্কেট থানা থেকে বাড়তি পুলিশ পাঠাল লালবাজার। সব মিলিয়ে আহত আট জন। পুলিশ অনেককে গ্রেফতার করল। জানা গেল, বাজারের দখল নিয়ে এলাকার দুই সিন্ডিকেটের লড়াই ছিল সেই ঘটনা।
ঘটনা ৩: আনন্দপুরের গুলশন কলোনির একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ছাদ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালাচ্ছে কয়েকটি মোটরবাইকে সওয়ার যুবকেরা। সেই ছাদ থেকেও উড়ে আসছে একের পর এক বোমা। প্রায় সিনেমার মতো এমন দৃশ্য দেখে হতবাক পুলিশ। শেষে কোনওক্রমে অবস্থা সামলে ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়। জানা যায়, গুলশন কলোনির যে সিন্ডিকেটের মাথা ওই বাড়িটি তৈরি করছিল, তাকে সরিয়ে বাড়িটির দখল নিয়েছিল পাশের পাড়া মার্টিন কলোনির আর এক সিন্ডিকেটের দাদা। হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের সিন্ডিকেট-লড়াইয়েই এই কাণ্ড।
গত কয়েক মাসে সিন্ডিকেট বনাম সিন্ডিকেট লড়াইয়ের এমন উদাহরণ প্রচুর। বোমা, গুলি চললে তো বটেই, হাতাহাতি থেকে এলাকায় ভাঙচুরের খবরও শিরোনামে উঠে আসছে প্রায়ই। যা প্রশ্ন তুলছে, তবে কি একটি এলাকায় গজিয়ে উঠছে একাধিক সিন্ডিকেট? এলাকার রাশ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দুই সিন্ডিকেটের লড়াইয়েই কি বাড়ছে অশান্তি, হিংসা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত পুর ভোটের পর থেকেই শহর কলকাতায় শুরু হয়ে গিয়েছে এক নয়া সিন্ডিকেট-সমীকরণ। আর তার জেরে প্রায়ই সামনে আসছে সিন্ডিকেট বনাম সিন্ডিকেটের লড়াইয়ের খবর।
ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, এমনিতে রাজনৈতিক নেতা-দাদাদের আশীর্বাদধন্য সিন্ডিকেটের জুলুম সব থেকে বেশি চলে আবাসন ও ফ্ল্যাট তৈরির নামে। শুধু বালি-পাথরকুচি-ইট সরবরাহ করাই নয়, তাঁদের ‘দাক্ষিণ্যে’ তৈরি হয় গোটা আবাসনই। অভিযোগ, ‘আশীর্বাদের খামে’ ভাগের টাকা বুঝে নিয়ে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই এলাকায় বাড়ি করার অনুমতি দেন ওই নেতা-দাদারা। কোথাও ভাগের হিসাব প্রতি বর্গফুটে ৮০০ টাকা, কোথাও হাজার টাকারও বেশি। বেআইনি নির্মাণ হলে তো কথাই নেই! পুরসভার অনুমতি নিয়ে বাড়ি করতে গেলেও তুষ্ট করতে হয় সিন্ডিকেটের মাথাদের। না-হলে বাড়িতে জলের সংযোগ আসে না, তবে মাঝেমধ্যে আসে কাজ কী করে শেষ হবে, এই বলে দেখে নেওয়ার হুমকি! কিন্তু সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে যত দ্রুত ‘আশীর্বাদের খাম’ জায়গা মতো পৌঁছয়, ততই বাড়ে কাজের গতি। প্রশাসনিক ঝামেলা থাকে না, কেউ নাকও গলায় না।
কিন্তু গত পুরসভা ভোটের পর থেকেই খাম কে আগে পৌঁছে দিতে পারে, তা নিয়েই অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকার এমনই এক সিন্ডিকেট সদস্যের কথায়, ‘‘এমন খাম দেওয়ার ক্ষমতা আসে এলাকা হাতে থাকলে। ফলে দখল নিতে যে যেখানে খুশি ঢুকে পড়ছে। ফলে প্রতি দিনই ঝামেলা হচ্ছে। আগে দাদারা বসে এলাকা ভাগ করতেন। কিন্তু এখন তাঁরাও চুপ। যে যত দ্রুত আর বেশি মোটা খাম পাঠাচ্ছে, এলাকা তার।’’
উত্তর কলকাতার এক নেতা-দাদা আবার বললেন, ‘‘পুর ভোটের পরে আসলে গোটা ব্যবস্থাটাই পাল্টে গিয়েছে। বহু এলাকায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলেছে। পুর প্রশাসনিক কাজে নতুন মুখ এসেছে। নতুন নেতার লোক এলাকা দখল করতে নামছে, পুরনোরা জায়গা ছাড়তে চাইছে না। উপরে যারা বসে আছে, তারা হিসাব মিলিয়ে দেখছে যে, আগের লোক তাকে বেশি ভাল রাখত না কি এখনকার লোক! এই হিসাব না মিললেই গন্ডগোল।’’
হিসাব না মেলারই অভিযোগ তুললেন উত্তর কলকাতায় কাজ নেওয়া এক প্রোমোটার। বললেন, ‘‘একটা বাড়ি তৈরির কাজে হাত দিয়েও এগোতে পারছি না। ওই এলাকার দায়িত্ব পাওয়া নতুন নেতা এক রকম ভাগের হিসাব চাইছেন, পুরনো নেতা অন্য রকম। এক জনের সঙ্গে এগোতে গেলে অন্য জন এসে হিসাব বুঝে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।’’
কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বললেন, ‘‘কোনও এলাকাতেই এমন কোনও সেটিংয়ের গল্প নেই। যেখানে গোলমাল হচ্ছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অন্য কেউ নয়, বেআইনি কিছু হলে পুলিশই তার হিসাব নেবে।’’