ফুটনানি চেম্বারের বেহাল দশা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কথা ছিল, ক্ষতিগ্রস্ত এবং কাঠামোগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া, যে কোনও ধরনের বড় বিপদের মুখোমুখি দাঁড়ানো পুর ভবন লাগোয়া ফুটনানি চেম্বার সংস্কারের কাজ দ্রুত শুরু করবে কলকাতা পুরসভা। সেই মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ-দল ওই ভবনের কাঠামোগত প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ফুটনানি চেম্বার ‘দখলদার’ গোষ্ঠীর কারণে সেই কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর। আর এই অহেতুক দেরি বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করছেন পুরকর্তারা।
কারণ, একেই দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে ফুটনানি চেম্বারের বহু জায়গা চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার উপরে দখলদারদের অনেকেই ভবনের ভিতরে ‘ইচ্ছে মতো’ বেআইনি নির্মাণ করেছে। যা মূল কাঠামোর ‘নিজস্বতা’র উপরে প্রভাব ফেলেছে এবং কাঠামোকে আক্ষরিক অর্থেই দুর্বল করে তুলেছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে ভবনের একাংশের (এলিট সিনেমা হলের বিপরীতের অংশ) ভিত বসে যাওয়ায়। আর সেই কারণেই কাঠামোগত নিরীক্ষণের বিষয়টি বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ, ভবনের কাঠামোগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গাণিতিক হিসেব-নিকেশের উপরেই সামগ্রিক সংস্কারের হিসেব-সূত্রটি দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। যে হেতু কাঠামোগত বিচ্যুতি কোথায় কোথায় হয়েছে এবং কতখানি, সেটা ধরা পড়বে তার মাধ্যমেই। কিন্তু এখানেই দেখা দিয়েছে সমস্যা। কারণ, বিশেষজ্ঞদের কাজ করা নিয়ে তারা যে মোটেই ‘সন্তুষ্ট’ নয়, তা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক ভাড়াটে।
প্রসঙ্গত, নিউ মার্কেটের পুরনো কমপ্লেক্স (হগ মার্কেট) এবং ফুটনানি চেম্বার সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। সমীক্ষক দলের সদস্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর গোকুল মণ্ডল এবং ভিজ়িটিং প্রফেসর বিশ্বজিৎ সোম জানাচ্ছেন, কলকাতায় হাতে গোনা বড় ভবনগুলির মধ্যে অন্যতম এই ফুটনানি চেম্বার। গোটা চেম্বার চার পাশ দিয়ে নিরীক্ষণ করতে গেলে কাউকে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হবে। ‘‘হগ মার্কেট সংস্কারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং ফুটনানি চেম্বার সংস্কারের কাজ!’’, বলছেন বিশ্বজিৎবাবু।
কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের পথেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দখলদার-সমস্যা। এমনিতে বছর চারেক আগে আইনি লড়াইয়ে জিতে ফুটনানি চেম্বারের মালিকানা পেলেও তার পুরোপুরি দখল নিতে এখনও বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে পুরসভাকে। কারণ, চেম্বারের চারটি তল জুড়েই ‘দখলদারেরা’ রয়েছে। এমনকি, ২০১৯-’২০ সালে ‘সরকারি এলাকা (বেআইনি দখলদার উচ্ছেদ) আইন, ১৯৭১’ অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ কালেক্টরের কাছে (অফিস অব দ্য ফার্স্ট ল্যান্ড অ্যাকুইজ়িশন কালেক্টর, কলকাতা) পুরসভার রুজু করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কালেক্টর অফিস প্রায় ২০০ জন ভাড়াটেকে উচ্ছেদ নোটিস পাঠালে তাদের প্রায় ৮০ জন জানায়, তারা ‘দখলদার’ নয়। তারা ‘ভাড়াটে’। যার সব ক’টিই খারিজ করে দিয়ে পুরসভা আবার জানায়, আদালতের নির্দেশে রিসিভারের মাধ্যমে আবেদনকারীদের থেকে ‘অকুপায়ার্স চার্জ’ নেওয়া হলেও তারা প্রত্যেকেই বেআইনি দখলদার।
আর ‘ভাড়াটে’ এবং ‘দখলদারের’ এই দাবি-পাল্টা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুর নথির উল্লেখ করে পুরকর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ১৯১০-’১১ সালে ‘হিন্দুস্থান কোম্পানি ইনশিয়োরেন্স’ নামে একটি সংস্থাকে ৯৯ বছরের জন্য ফুটনানি চেম্বার লিজ়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন পুর কর্তৃপক্ষ। লিজ়ের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও অন্য একটি সংস্থা নিজেদের ‘সাব লিজ় হোল্ডার’ হিসাবে দাবি করে সংশ্লিষ্ট ভবনটি তাদের দখলে রেখেছিল। শেষে ২০১৮ সালে আদালতের রায়ে ফুটনানি চেম্বার পুরসভার দখলে আসে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুরসভার এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, ওই ভবনে আবাসিক, রেস্তরাঁ, দোকানপাট-সহ ২০০ জনের মতো ভাড়াটে আছে। সবাই বেআইনি দখলদার। কারণ, তাদের যে সংস্থা ভাড়া দিয়েছিল, তারা পুরসভার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে হেরে গিয়েছে। তা ছাড়া, ২০০৯ সালেই লিজ় চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে। ওই শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘তার পরেও শতাধিক দখলদার উচ্ছেদ নোটিসের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও নিজেদের উত্তর জানায়নি। সেই কারণে পুরো প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য ফের কালেক্টরের কাছে আবেদন জানাব আমরা।’’
কিন্তু তাতেও জটিলতা মিটবে কি? কারণ, ফুটনানি চেম্বার সংস্কারের ভবিষ্যৎ তো ভাড়াটে-দখলদার শব্দবন্ধের ‘ফাঁকে’ থমকে রয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে!