আক্রান্ত: তাণ্ডবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কলা বিভাগের ইউনিয়ন রুমের পাশে তড়িৎদার (ইনসেটে) এই দোকানও। শুক্রবার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজস্ব চিত্র
সিকি শতক হয়ে গেল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেটের সঙ্গে তাঁর অস্তিত্ব একাকার। ক্যাম্পাসে এই ধরনের হিংসা বা তাণ্ডব তিনি আগে কখনও দেখেননি।
তাঁর মাথার ক্ষত হয়তো দ্রুত সেরে যাবে ওষুধ-ইঞ্জেকশনের সৌজন্যে, কিন্তু তড়িৎবরণ দাশের উপরে হামলা যাদবপুরের পড়ুয়া-শিক্ষক-প্রাক্তনী সকলের বুকেই তীব্র অভিঘাতে বাজছে। এবিভিপি-র নাম লেখা, তাণ্ডবে ধ্বস্ত আর্টস ইউনিয়ন রুমের পাশে ‘তড়িৎদা’র চিলতে দোকানঘরটাই শুক্রবার যেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। জনে জনে চেনা-অচেনা ছাত্রছাত্রী এসে ‘তড়িৎদা, আমরা কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি?’ বলে এক বার ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন।
১৯৯৪ সালের মার্চ থেকে তড়িৎবাবুর দোকান পাল্টেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। গোড়ায় তা ছিল টেলিফোন বুথ। পরে মোবাইল চার্জ করার দোকানে রূপান্তরিত হয়। এখন তা খাতা-পেন-ফোটোকপির জায়গা, মোবাইল চার্জ করার বন্দোবস্ত যদিও বজায় আছে। কৈশোরে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে দুরারোগ্য হাড়ের টিউমারে ক্রাচ-নির্ভর হয়ে পড়েন তড়িৎবাবু। কিন্তু এখনও ৫৬ বছরের প্রৌঢ়ের মনের জোর, ধৈর্য, সহৃদয়তায় খামতি টের পান না যাদবপুর পরিবারের কেউ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাবুল সুপ্রিয়ের উপস্থিতি নিয়ে উত্তপ্ত যাদবপুরে সেই তড়িৎবাবুই কিছু ক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। সন্ধ্যার মুখে বাইরে হিংস্র জনতার সামনে চার নম্বর গেটের পাল্লা তখন কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাইরে টায়ার-পোড়া আগুন আর বাতাসে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার এবং টুকরো-টাকরা অপশব্দের তোড় এসেছে একযোগে। শুক্রবার বিকেলে ‘তড়িৎদা’ বলছিলেন, ‘‘মূল ফটকের পাশের ছোট গেটের তালাটা ওরা ভেঙে ফেলেছে দেখেই আমি দোকানের দরজা বন্ধ করে দিই।’’ তিনি এখনও ভেবে পাচ্ছেন না, তাঁকে কেন ওই ‘দুর্বৃত্ত’দের আক্রোশের শিকার হতে হল। ‘‘এত বাইরের ছেলে এবং এই হিংস্র ভাব যাদবপুরে আগে দেখিনি। ক্রিকেটের স্টাম্প নিয়ে আমার দোকানের কাচের পাল্লাটা কেন নিশানা করল, কে জানে!’’ সেই ভেঙে যাওয়া কাচ ছিটকেই তড়িৎবাবুর মাথায় রক্তারক্তি। তবু সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে টানা রাত সওয়া আটটা পর্যন্ত ওইটুকু দোকান বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বসেছিলেন তিনি। বাইরে তখন আর্টস ইউনিয়ন রুম তছনছ করা হচ্ছে।
এ দিন যাদবপুরের ধিক্কার মিছিলেও বহু দিন বাদে ক্যাম্পাসে আসা দেড় দশক-দু’দশক আগের প্রাক্তনীরা আলোচনা করছেন, ‘তড়িৎদার জন্য কী করতে পারি আমরা?’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অনুরোধ সামলাতেও তড়িৎবাবুর যেন মুখে ব্যথা। তিনি পরে বললেন, ‘‘এই ভালবাসা ভুলতে পারব না। তবে রেজিস্ট্রার নিজে আমায় বলেছেন, দোকানের কী ক্ষতি হয়েছে জানাতে। সুতরাং সবাইকে বলছি, আমার জন্য টাকা তোলার দরকার নেই।’’
যাদবপুর থেকে দর্শনে এমএ, তার পরে বিএড পাশ করা প্রতিবন্ধী তড়িৎবাবুকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই চার নম্বর গেটের পাশে দোকান করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেখানে চার নম্বর গেটের বাইরে মিছিলের দিকে তাকিয়ে তড়িৎবাবু বললেন, ‘‘বহু বছর আগে মণ্ডল কমিশনের মিছিলে ক্রাচ নিয়েই হেঁটেছিলাম। এখন বয়স হয়েছে। কিন্তু মনটা এই মিছিলের সঙ্গেই হেঁটে যাচ্ছে।’’