প্রতীকি ছবি
ছিপছিপে, রোগাটে চেহারার ছেলেগুলো আর ঠিক রোগা নেই। গত দেড় বছরে তারা মাথায় খানিকটা লম্বা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লম্বার চেয়ে বেশি প্রস্থে বেড়েছে। খেলাধুলো, দৌড়াদৌড়ি করতে গেলে যেন একটুতেই হাঁফিয়ে উঠছে। আগেকার সেই শারীরিক সক্ষমতা ওদের আছে তো?
প্রায় দেড় বছর পরে নবম শ্রেণির কয়েক জন পড়ুয়াকে দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের রামমোহন মিশন হাইস্কুলের অধ্যক্ষ সুজয় বিশ্বাস। তিনি বলেন, “আগে যেখানে একটি ক্লাসের এক জন বা বড়জোর দু’জন পড়ুয়ার ওজন বেশি ছিল, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে একটি ক্লাসে বেশ কয়েক জন পড়ুয়ার ওজন বেড়েছে।’’
সুজয়বাবু জানান, অনলাইন ক্লাসের সময়ে মোবাইলে বা ল্যাপটপের পর্দায় দেখা যেত পড়ুয়াদের। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের যে ওজন খানিকটা বেড়েছে, সেটা ওই পড়ুয়াদের সামনে থেকে না দেখলে বোঝা যেত না। তিনি জানান, এই সমস্যা সামলাতে তাঁরা ঠিক করেছেন, আলাদা করে পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য সচেতনতার পাঠ দেবেন। প্রয়োজনে পেশাদার ডায়েটিশিয়ানদের স্কুলে এনে কয়েকটি ক্লাসও করানো যেতে পারে।
এই সমস্যা শুধু রামমোহন মিশন স্কুলের পড়ুয়াদেরই নয়। শহরের বেশ কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, দেড় বছরেরও বেশি বাড়িতে বন্দি থাকার পরে স্কুলজীবনে ফিরে অনেক পড়ুয়ার মধ্যেই শারীরিক সক্ষমতার অভাব দেখা যাচ্ছে। যার অন্যতম প্রধান কারণ ওজন বৃদ্ধি। খাওয়াদাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ এনে কী ভাবে ওই পড়ুয়ারা আগের সক্ষমতা ফিরে পাবে, তার পরামর্শ দিতে শুরু করেছে স্কুলগুলি।
রিজেন্ট পার্ক এলাকার ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলের অধ্যক্ষ রঞ্জন মিত্র জানালেন, স্কুলে যখন পড়ুয়ারা আসে তখন তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় তারা বাড়িতে কী ধরনের খাবার খাচ্ছে, সেই দিকে নজর রাখা তো সম্ভব নয়। রঞ্জনবাবু বলেন, “স্কুল চালু হওয়ার পরে আমরা অভিভাবকদের সতর্ক করছি, তাঁরা যেন বাচ্চাদের টিফিনে কোনও ভাবেই ফাস্ট ফুড না দেন। এমনিতেই করোনা পরিস্থিতিতে টিফিন খাওয়া নিয়ে অনেক বেশি সাবধান থাকতে হবে।’’ তিনি জানান, তাঁদের স্কুলের ক্যান্টিনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি হত। ফের ক্যান্টিন চালু হলে সে দিকে আরও জোর দেওয়া হবে। রঞ্জনবাবু বলেন, “বিভিন্ন আনাজ দিয়ে বিরিয়ানি বানানো হয় আমাদের স্কুলের ক্যান্টিনে। সেটা নামেই বিরিয়ানি, কিন্তু আদতে পুষ্টিকর খাবার।’’
লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ়ের অধ্যক্ষ জন স্টিফেন জানান, অনলাইন ক্লাসের সময় নির্দিষ্ট হওয়ায় পড়ুয়াদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা সব সময়ে সম্ভব হত না। তবে অষ্টম শ্রেণির চেয়ে নিচু ক্লাসের ছেলেদের শারীরিক সক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য ওদের অনলাইনে যোগাসনের ক্লাস দেওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষ বলেন, “নিচু ক্লাস চালু হওয়ার পরে আরও বেশি করে এই ধরনের পরামর্শ দেওয়া হবে।’’
শ্রী শিক্ষায়তনের মহাসচিব ব্রততী ভট্টাচার্য জানান, এখন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা স্কুলে আসছে। তাদের অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতন এবং ওজন বাড়লে মেপে খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে। ব্রততীদেবী বলেন, “আমাদের প্রধান চিন্তা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের নিয়ে। ওরা তো এখনও বাড়িতেই আছে। তাই অনলাইন ক্লাসে মাঝেমধ্যেই শিক্ষকেরা তাদের স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও বাড়িতেই যোগব্যায়াম করার পরামর্শ দিচ্ছেন। অভিভাবকদেরও সচেতন করা হচ্ছে।’’
করোনাকালে বাইরে খেলতে না গেলে বাড়িতেই অন্তত স্কিপিং করুক পড়ুয়ারা। এমনই পরামর্শ দিচ্ছেন ডায়েটিশিয়ান স্মিতা খন্না রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, “বহু বাচ্চার ওজন তো বাড়ছেই, সেই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে আরও নানাবিধ সমস্যা। মূলত হজমের গোলমাল, ডায়াবিটিস, লিভারের অসুখ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বকের সমস্যা হচ্ছে তাদের।’’ স্মিতার মতে, টিফিনে বা বাড়িতে প্যাকেটজাত খাবার, জাঙ্ক ফুড বন্ধ করতে হবে। টিফিনে গোটা ফল, যেমন আপেল বা কমলালেবু দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, “স্কুলের স্বাভাবিক জীবনে ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে আনতে সবার আগে দরকার শারীরিক সক্ষমতা। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে অনেকেরই বেশি রাত করে ঘুমোনোর অভ্যাস হয়েছে। তা পাল্টাতে হবে। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া ভীষণ জরুরি। ফিরিয়ে আনতে হবে বেশি করে জল খাওয়ার অভ্যাসও।’’