ছবি: সংগৃহীত।
শুধু দেখলেই হবে! সুন্দর সুন্দর ছবির বই পাতা উল্টে না-পড়লে আর মজা কই, হেসে বোঝাচ্ছিলেন ‘আহসানা আপা’।
ক্লাস থ্রি-র ইশিকা শুনে জিভের আড় ভেঙে পড়তে চায় গড়গড়িয়ে। নুর আহসানা খাতুন দেখেন, দু’বছরের স্কুলবিহীন জীবনে অনলাইন ক্লাসে বসলেও পড়ার অভ্যাস ধাক্কা খেয়েছে বালিকার। আহসানা তাই বোঝান, মানে বুঝে পড়তে হবে! পড়ার ফাঁকে থামাটাও পড়া। দু’টি বাক্যের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে একটা দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ। ইংরেজিতে ফুলস্টপ। সেই পূর্ণচ্ছেদের মানে না-বুঝে অনেক খুদেই নাগাড়ে পড়তে চায়! তাদের সেই অভ্যাস শুধরে দিয়ে বলতে হয়, কী ভাবে পড়লে চাখা যাবে পড়ার মজা!
আর এক শিক্ষিকা সলমা খাতুন হালদার আবার দেখেছেন, পড়তে গিয়ে যুক্তাক্ষরে হোঁচট খাচ্ছে অনেকেই। রুমানা খাতুন নামে অন্য এক জন বলছেন, “পড়া এবং প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ, দুটোই বন্ধ অনেকের। বইয়ের ছবিতে ফড়িং দেখে একটি ছোট মেয়ে বলল, কার্টুনে দেখলেও সত্যিকারের ফড়িং সে দেখেনি!” সাঁতরাগাছি লাগোয়া নানা পাড়ার খুদে ‘পোড়োর দল’ বেশির ভাগই ওস্তাগর ঘরের ছেলে-মেয়ে। স্কুলবিহীন ক্লাসের দিনে বাড়িতে পড়া ধরার কেউ নেই অনেকেরই! তাই অভ্যাসে মরচে ধরেছে। ক্রমশ আরও পিছিয়ে যাচ্ছে পিছিয়ে থাকা ঘরের পড়ুয়ারা। করোনাকালের স্কুলবিহীন ইস্কুলবেলায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সাঁতরাগাছির দ্বীনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজের সদ্য তরুণী ছাত্রী ও শিক্ষিকারা। নিজেদের পড়ার ফাঁকে ফি-বুধবার এক আশ্চর্য পড়ার ক্লাস শুরু করেছেন তাঁরা। মুন্সিডাঙা, গড়পা, নিবড়া, অঙ্কুরহাটিতে আশপাশের পাড়ার স্কুলপড়ুয়ারা বেশির ভাগই পিছিয়ে থাকা ঘরের। মোবাইল নাড়াচাড়া যা-ও বা রপ্ত হয়েছে, দিনভর পড়া দেখানোর লোকের অভাবে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নামমাত্র। বরং আগের শেখা পড়াগুলোও ভুলতে বসেছে তারা। সাঁতরাগাছির কলেজের প্রতিষ্ঠাতা তথা সাধারণ সম্পাদক শেখ হায়দর আলি বলছিলেন, “কলেজের মেয়েদের পড়ানোর উৎসাহের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। আশপাশের বিভিন্ন পাড়ার মাঠে, উঠোনে, মন্দির বা মসজিদ চত্বরে বসে এই অভিনব ক্লাস। ওরা যার নাম দিয়েছে ‘পড়ার আনন্দে’! আমরা চাইছি, গল্পের বই পড়তে পড়তেই স্থানীয় পড়ুয়ারা বইকে নতুন করে ভালবাসুক!” রাজ্যে কলেজ খোলার কিছু দিন আগেই হস্টেলবাসী শিক্ষিকা আর কয়েক জন ছাত্রী মিলে এই প্রয়াসে শামিল হয়েছেন।
ছোটরা যাতে সহজে পড়তে পারে, তার জন্য রংচঙে ছবিওয়ালা নতুন বই জোগাড় করেছেন কলেজের সুহৃদবর্গই। বই দিতে এগিয়ে এসেছেন কিছু প্রকাশকও। বুধবারের ক্লাসে পড়ুয়া-শিক্ষিকাদের সঙ্গে গল্প করতে মাঝেমধ্যে ঘুরে যাচ্ছেন ছোটদের বইয়ের লেখক, কলেজের অধ্যাপক বা সমাজকর্মীরা। কলেজের এক কর্মকর্তা শেখ মুরসালিন হাসছেন, “আশপাশের নানা পাড়ায় গল্পের বই পড়ার ইস্কুল চললেও প্রতি বুধবারই কিছু বাচ্চা কলেজে চলে আসছে। তাদের আবার টোটোয় করে পড়ার জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে।” এলাকার স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত অঙ্কের মাস্টারমশাই গোবিন্দ ঘোষ, কম্পিউটার স্যর নাসিমুল সর্দার, আনোয়ার মাস্টারেরাও এই অভিনব ইস্কুলের পাশে।
সাঁতরাগাছির কলেজের ছাত্রী, স্থানীয় বাসিন্দা হালিমা, গুলশানারা, কেশপুরের রুমানা, বর্ধমানের কলেজশিক্ষিকা আহসানা, পূর্ব মেদিনীপুরের রাধামণির সলমা বা সাঁতরাগাছির ফ্রিনা খাতুনেরা ছোটদের ধৈর্য ধরে পড়াচ্ছেন। তাঁরা নিজেরাও ছোটখাটো পোশাক বিক্রেতা, রাজমিস্ত্রি, ছোট চাষি বা ভিন্ রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকের মেয়ে। সাঁতরাগাছির কলেজের কাছেই থাকেন ওস্তাগর পরিবারের সন্তান, বাঙালি মুসলিম সমাজ নিয়ে সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘তালাশনামা’র লেখক ইসমাইল দরবেশ। তাঁর কথায়, “দেখলে আশা জাগে, রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়েদের গুটিয়ে থাকা, জড়োসড়ো ভাবমূর্তি ভেঙেই এই শিক্ষিকারা ঘুরে ঘুরে এলাকার বাচ্চাদের বড় ভরসা হয়ে উঠছেন।”