বাবা-মায়ের সঙ্গে সৌভিক। নিজস্ব চিত্র
পুজোয় ঢাক বাজাতে পারব তো? ডাক্তারবাবুর কাছে প্রশ্ন ছিল, শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা শয্যাশায়ী আঠেরো বছরের তরুণের। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেশক্তির কাছে হার মেনেছে রোগ। তবে তাঁকে সারিয়ে তোলার পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িয়ে রয়েছে চিকিৎসকদেরও।
এ বছর জয়েন্ট পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র সৌভিক মুখোপাধ্যায়ের। গত ১০ জানুয়ারি বাবা কাজল মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেন, পরীক্ষার আবেদনপত্রে ছেলে সই করতে পারছেন না। ওই দিন বিকেলেই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ছাদে পড়ে যান বীরভূমের রামপুরহাটের বাসিন্দা সৌভিক। পরের দিন সকালে একেবারে শয্যাশায়ী। ছেলে তখন ঘাড়ও তুলতে পারছে না। সঙ্গে শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা। রামপুরহাটের চিকিৎসকের পরামর্শে সৌভিককে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজন ওই দিনই কলকাতার মল্লিকবাজারে স্নায়ুরোগের একটি বেসরকারি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। বাবা কাজলবাবুর কথায়, ‘‘ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় যখন পৌঁছেছি, তখন ছেলে হাত-পা নাড়াতে পারছে না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ওই অবস্থা থেকে চিকিৎসক সন্তোষ ত্রিবেদী এবং সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় আমার ছেলেকে সুস্থ করে তুলেছেন।’’
চিকিৎসক সন্তোষ ত্রিবেদী জানান, সৌভিক ‘ক্রনিক ইনফ্লামেশন ডিমাইলেটিং পলিনিউরোপ্যাথি’ রোগে আক্রান্ত হন। এটি এক ধরনের ‘অটোইমিউন ডিসরেগুলেশন’। যার ফলে বাইরের অ্যান্টিজেনের সঙ্গে শরীরের ভিতরের অ্যান্টিবডির বিরোধ বাধে। অ্যান্টিবডি তার স্নায়ুরই বিরুদ্ধাচরণ করলে মাংসপেশী দুর্বল হতে থাকে। আক্রান্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। কিছু কিছু রোগীর শ্বাসকষ্ট থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। সৌভিকের শ্বাসকষ্ট যাতে না হয় সে জন্য গলায় ফুটো করে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসক সন্তোষের কথায়, ‘‘ইনফ্লামেটরি ডিমাইলেটিং নিউরোপ্যাথি ক্রনিক অথবা অ্যাকিউট হতে পারে। সৌভিকের রোগ ক্রনিক হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল ছিল।’’
ভেন্টিলেটর, আইটিইউ, এইচডিইউয়ের লড়াইয়ে শুরু থেকেই সৌভিকের রিহ্যাবে জোর দিয়েছিলেন বেসরকারি হাসপাতালের ‘নিউরো রিহ্যাবিলিটেশন’এর অধিকর্তা-চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তিন মাস ভেন্টিলেশনে ছিলেন সৌভিক। মা মিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রিহ্যাব পুরো সঞ্জীবনীর মতো কাজ করেছে।’’ শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে মার্চে বেসরকারি হাসপাতালের রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে সৌভিককে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসক সুপর্ণ বলেন, ‘‘শিশুকে যে ভাবে হাঁটাচলা, কথা বলা শেখানো হয়, সৌভিকের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সে রকম ছিল। ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে রোগীকে নিজের কাজ নিজেকে করতে শেখানো হয়। স্নায়ুরোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে রিহ্যাব কী করতে পারে তার প্রমাণ সৌভিক। তবে ওর অদম্য ইচ্ছাশক্তিও অনেকের কাছে শিক্ষণীয়।’’
সেই ইচ্ছাশক্তির পিছনে রয়েছে পুজোর টান। শারদ উৎসবে পরিজনদের মাঝে ফেরার আনন্দ। মিতা জানান, বাড়ির এক মাত্র ছেলে পুজোর সময়ে ঢাক বাজাবেই। এক ফাঁকে গত বছর ছেলের ঢাক বাজানোর ভিডিয়ো দেখালেন। ভিডিয়োয় মাতৃমূর্তির সামনে ছেলের ঢাক বাজানো ছবি দেখে বিহ্বল তাঁর মা। এক সময় চোখের নিমেষে সন্তানের শরীর পাথর হতে দেখেছেন। মিতার কথায়, ‘‘আইটিইউয়ে থাকাকালীন কানের কাছে ধীর গলায় বলতাম, বাবু হাত নাড়াও। ডান দিকে তখনও সাড় ছিল না। বাঁ হাতের আঙুল অল্প নাড়াত। ওই দেখেই মনে বল পেতাম।’’
সৌভিক বলেন, ‘‘ঢাক যাতে বাজাতে পারি, সে জন্য সব সময়ে নিজেকে বলতাম, সুস্থ হতেই হবে। ধৈর্য হারিয়ে লাভ নেই। পুজোর সময়ে হাতে ঢাকের কাঠি তুলতে পারব ভেবেই ভাল লাগছে।’’ পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মা। ছেলের মুখ থেকে কথা কেড়ে মা বললেন, ‘‘দুগ্গা, দুগ্গা’’।