ধর্মতলার কার্জন পার্কে জমে রয়েছে জল। নিজস্ব চিত্র।
কেউ ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে হারিয়েছেন দু’দিনের জ্বরে। কেউ একই কারণে পাঁচ বছরের ছেলেকে হারিয়ে পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। কারও আবার পুত্রবধূ মারা গিয়েছেন ছোট্ট নাতনিকে তাঁর দায়িত্বে রেখে।
গত কয়েক বছরে শহরে ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর খবর এসেছে একের পর এক। গত বছর থেকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা অতিমারি। এই সব রোগ প্রতিরোধ করতে পুরসভা কতটা তৎপর, আসন্ন পুরভোটের আগে তা নিয়ে চুলচেরা বিচার শুরু হয়েছে নানা মহলে। দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যে মৃতের পরিবারের লোকজন বলছেন, ‘‘আরও সতর্ক হলে অনেক মৃত্যুই হয়তো এড়ানো যেত। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা কিন্তু ভোট-প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভোলানো যাবে না।’’
পুর প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৭ সালে বর্ষার পরেই কলকাতা ও শহরতলিতে ভয়াবহ আকার নেয় ডেঙ্গি। রাজ্যে ওই রোগে মারা যান অন্তত ৪৬ জন। একই চিত্র দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালেও। ওই বছরে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৬০-এর কাছাকাছি। অভিযোগ উঠেছিল, মৃত্যুমিছিল দেখেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি সামলানোর পরিবর্তে তথ্য গোপন করার দিকেই নজর বেশি ছিল প্রশাসনের। অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়েছিল, মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি নয়, অজানা জ্বর। ২০১৯-’২০ সালে করোনা আক্রান্তের সংখ্যার ধাক্কায় অনেকটাই আড়ালে চলে যায় ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া নিয়ে আলোচনা।
পুরসভা জানাচ্ছে, অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে ১০ নম্বর বরো ছিল শীর্ষে। তার পরেই ছিল ১২ এবং ১১ নম্বর বরো। তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে ছিল যথাক্রমে ১৪ এবং ১৬ নম্বর বরো। ওই এলাকাগুলিতে প্রথম কন্টেনমেন্ট জ়োন তৈরি করা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে পুরসভার সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগ সামনে আসে। এর পরে জরুরি সময়ে অ্যাম্বুল্যান্স না-পাওয়া, বার বার বলেও আক্রান্তের বাড়ি জীবাণুমুক্ত না করার মতো অভিযোগ আসতে শুরু করে। রোগীকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের চলে যাওয়ার মতো ঘটনা যেমন ঘটেছিল, তেমনই বহু পাড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকলেও পুর পরিষেবা না পাওয়ার অভিযোগও সামনে এসেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, বহু জায়গায় মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার মতো লোক পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে আবার আঁকশি দিয়ে শ্মশানে মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো নারকীয় ঘটনাও ঘটেছিল।
বর্তমানে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলেও নতুন করে বাড়ছে ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়া। পুর স্বাস্থ্যকর্তাদের যদিও দাবি, ২০২০ সালে ৮৪ হাজার জনের ডেঙ্গি পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাতে আক্রান্তের হার ছিল ২.৬%। এ বছর এক লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষের ডেঙ্গি পরীক্ষা হয়েছে। আক্রান্তের হার ১.৬%। গত বার ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল, এ বার এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন আট জন। পুর স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০১৯ সালে শহরে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৪২৫। পরের বছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৭৩৬-এ। ২০২১-এর নভেম্বর পর্যন্ত সেই সংখ্যা আবার পৌঁছেছে ৪৮৫৪ জনে। পুরকর্তাদের দাবি, ৪, ৫, ৬ এবং ৭ নম্বর বরো এলাকায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা।
কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০১৯-’২০ সালের পুর বাজেটে মশাবাহিত রোগ নিরাময়ে প্রায় ৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা পুরসভার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক। মশা দমনে ভেক্টর কন্ট্রোল বিভাগের অধীনে ৪১টি গাড়ি বছরভর কাজ করে। লাগাতার অভিযান এবং বরোভিত্তিক বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কারণেই কমেছে আক্রান্তের সংখ্যা। পুরসভার বিদায়ী প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য অতীন ঘোষ বলেন, ‘‘ফের সুযোগ পেলে ওয়ার্ডভিত্তিক অতিরিক্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সহজে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সুযোগ করে দিতে ১৬টি বরোয় পৃথক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্তও পাকা।’’
বড়বাজারে একটি বাড়ির কার্নিসে জমে আবর্জনা। নিজস্ব চিত্র।
যদিও এর মধ্যেও বিঁধছে রাজ্যের স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের ‘মশারি পরামর্শ’! গত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া নিয়ে পুর স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সেখানে যে যে বরোয় মশাবাহিত রোগের প্রভাব বেশি, সেখানে বিশেষ এক ধরনের মশারি বিলির নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা। নির্দেশের পরে পেরিয়ে গিয়েছিল প্রায় দু’মাস। এর পরে ভোটের আগে তড়িঘড়ি করা হয়েছে কিছু মশারি বিলি।
নতুন পুর বোর্ডেও কি এই পুরনো অভ্যাসই চলতে থাকবে? ভোটের লড়াইয়ের মাঝে এটাই বড় প্রশ্ন।