—প্রতীকী চিত্র।
সাত বছরের অটিস্টিক শিশুর (যে কথাও বলতে পারে না) ‘স্পিচ থেরাপি’ চলছে। দেখা যাচ্ছে, এক হাত দিয়ে স্পিচ থেরাপিস্ট চেপে ধরেছেন সামনে বসা শিশুটির দু’হাত। অন্য হাত দিয়ে কখনও ঘুষি, কখনও জোরে টোকা দেওয়া চলছে। চলছে স্পিচ থেরাপির জন্য ব্যবহার হওয়া ‘ভাইব্রেটর ব্রাশ’ দিয়ে চোখে খোঁচানোও! কোনও মতে এক হাতের কনুই তুলে বার বার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে শিশুটি। আর উত্তরোত্তর বাড়ছে তার কান্না!
বেলেঘাটার আশুতোষ শাস্ত্রী রোডে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের একটি কেন্দ্রের এমনই এক ভিডিয়ো (সেটির সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি) সম্প্রতি সামনে এসেছে। শিশুটির মা এবং ওই কেন্দ্রেরতরফে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে পুলিশে। ভিডিয়ো ফুটেজটি তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। সেই সঙ্গেই পুলিশ উদ্ধার করেছে ভাইব্রেটর ব্রাশটি। এর পরে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৪ (কিছু দিয়ে আঘাত করা) এবং জুভেনাইল জাস্টিস আইনের ৭৫ নম্বর ধারায় একটি মামলা রুজু করেছে বেলেঘাটা থানা। যদিও গত ১২ জুলাইয়ের ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও পুলিশের এই পদক্ষেপকে যথেষ্ট মনে করছেন না কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ এবং শিশুটির মা। তবে বেলেঘাটা থানার বক্তব্য, অভিযোগ পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মামলা রুজুকরে অভিযুক্তকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। দ্রুত সব ধরনের পদক্ষেপ করা হবে।
গত রবিবারই এক অটিস্টিক যুবককে রাস্তায় শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল। টালিগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে ওই যুবকের পরিবার। নিগ্রহে অভিযুক্ত তিন নাবালক। সেই সময়েই অভিযোগ ওঠে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের উপরে হেনস্থা ধেয়ে আসে নানা ভাবে এবং নানা দিক থেকে। কখনও তা মানসিক, কখনও বা শারীরিক। কখনও সেই হেনস্থার জায়গা ক্লাসরুম বা খেলার মাঠ, কখনও বা অন্য কোনও জনপরিসর। এ শহরের কোথাও কি নিজেদের পুরোপুরি ‘নিরাপদ’ বলে ভাবতে পারেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্নেরা?
বেলেঘাটার কেন্দ্রে নিগ্রহের শিকার শিশুটির বাড়ি মৌলালি এলাকায়। ‘দীপরঞ্জনী ফাউন্ডেশন’ নামে ওই সেন্টারের প্রধান অমৃতা পাণ্ডা এ দিন বলেন, ‘‘শিশুটির ‘নন-ভার্বাল সিভিয়ার অটিজ়ম’ রয়েছে।গত নভেম্বর থেকে সে আমাদের প্রতিষ্ঠানে আসছে। আমাদের বিল্ডিংয়ের চারতলায় ওপিডি ইউনিট রয়েছে। অভিযুক্ত স্পিচ থেরাপিস্ট অপ্রতিম দাসের মালিকানাধীন‘প্রগতি স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’-এর স্পিচ থেরাপির ক্লাস চলে ওপিডি-তে। সপ্তাহে এক দিন অপ্রতিম ক্লাস নেন। গত ১২ জুলাই দুপুর ১টা থেকে এক ঘণ্টা ক্লাস চলার সময়েই ওই ঘটনা ঘটে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুরোটাই ধরা পড়েছে।’’ অমৃতার অভিযোগ, ঘটনা চলাকালীন শিশুটির মাকে ওই থেরাপিস্ট অন্য ঘরে বসতে বলেছিলেন। কেন্দ্রের আর এক আধিকারিক পাপিয়া রায় বলেন, ‘‘থেরাপি শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রচণ্ড কাঁদছিল শিশুটি। চোখের আশপাশ ধীরে ধীরে ফুলে উঠছিল। রাতে বাড়ি ফিরেও তার কান্না থামেনি। ওর মায়েরঅনুরোধে ওই রাতেই আমরা ক্লাসঘরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখি। তাতেই ওই নৃশংস অত্যাচার ধরা পড়ে। এর পরেই পুলিশের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’’
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বললেন, ‘‘যে হেতু শিশুটি কথা বলতে পারে না, তাই ওর অসহায়তা আরও বেশি। যে ঘটনা ওর সঙ্গে ঘটেছে,তার প্রভাব ওর ভবিষ্যৎ জীবনেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এত দিন পর্যন্ত ওর মধ্যে যে অসহায়তা ছিল, এরপরে তা আরও বাড়বে।’’ অভিযুক্ত শিক্ষক অপ্রতিমের সঙ্গে বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ভিডিয়োর সত্যতা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘বহু বছর ধরে এই পেশায় রয়েছি। এখনও বহু বাচ্চাকে শেখাচ্ছি। এ সব নিয়ে পরে কথা হবে।’’ ঘটনার পরে সাত দিন কেটে গেলেওএখনও এ নিয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই শিশুটির পরিবার। এ দিন তার মাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর চোখ বেয়ে শুধু জল গড়িয়েপড়েছে। কোনও মতে বলেছেন, ‘‘ছেলেটা প্রচণ্ড আতঙ্কে রয়েছে। ঘুমোতে পারছে না। সব সময়ে আমাকে আঁকড়ে থাকছে। অসহায় বাচ্চাটাকে স্যর এই ভাবে কেন মারলেন, জানি না।’’