সূর্য সেন স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিন । নিজস্ব চিত্র
তিনি নেই, সে কলেজ স্ট্রিটও নেই!
মির্জাপুর স্ট্রিট তথা সূর্য সেন স্ট্রিটের ফুটপাতে তখন হকার্স কর্নারের আড়াল ছিল না। অনেক দূর থেকে দেখা যেত, গোলদিঘি মানে কলেজ স্কোয়ারের রেলিং। রাস্তায় গাড়ির ভিড়ও কম। ‘‘বাবার কাছে শুনেছি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একেবারে ‘মিড্ল অব দ্য রোড’ ধরে হেঁটে আসতেন! ধার ঘেঁষে আসার লোকই নন তিনি।’’— বলছিলেন সঞ্চয় বড়ুয়া, ওই তল্লাটে ১০০ বছর পার করা ফেভারিট কেবিনের অন্যতম উত্তরাধিকারী। ‘‘অমন সুন্দর একটা মানুষ, অত লম্বা, টকটকে গায়ের রং— রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসছে! দৃশ্যটা ভাবুন তো!’’ তখন মির্জাপুর স্ট্রিটেই আর একটু ভিতরে মায়ের মামার বাড়িতে থাকতেন সৌমিত্রেরা। সেই গাড়িবারান্দা-বাড়ির থেকে হাঁটাপথ ৬৯ বি, সূর্য সেন স্ট্রিটের ‘ফেভারিট কেবিন’।
এমনিতে সাবেক কলকাতার রেস্তরাঁ, কেবিন বা মিষ্টির দোকানের বয়সের পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে চাটগাঁর নূতন বড়ুয়ার প্রতিষ্ঠিত চা-ঘরটির শতায়ু হওয়ার সম্ভাব্য সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসা নূতনচন্দ্র ১৯১৮-য় দোকানটির পত্তন করেন। গত মার্চে করোনার লকডাউনে বন্ধ ফেভারিট এখনও খোলেনি। নূতনচন্দ্রের বড় ছেলে দিলীপকুমারের পুত্র সঞ্চয়বাবু বলছিলেন, ‘‘আশায় ছিলাম সেপ্টেম্বরে দোকান খুলব। কিন্তু খরচা তো কম নয়! আমাদের তিন ভাইয়ের দোকান। কয়েকটি বিষয়ে মতভেদ আছে। কে জানে, দোকান কবে খোলা যাবে!’' শহরের ইতিহাস, যাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ টুকরো অত এব মুছে যাচ্ছে।
উল্টো দিকের গলি ধরে আঁকাবাকা হেঁটে চ্যাটার্জি লেনের ফেভারিটের মালিকদের সেকেলে বাড়ি খুঁজতে অবশ্য বেগ পেতে হয় না। সঞ্চয়বাবুর সহোদর সৈকত ট্যাংরাবাসী, কাকা বাদলের পুত্র অভিষেক প্রধানত বারুইপুরে থাকেন। তাঁরাই ফেভারিটের শরিক। সঞ্চয়ের বাবা-কাকারা গত এখন। তবে বাপ-ঠাকুরদার মুখে বার বার শোনা ফেভারিট-গরিমার কাহিনি সঞ্চয়েরও ঠোঁটস্থ। দাদুর মুখের লব্জ ধার করেই নজরুল ইসলামকে ‘কাজীসাহেব’ বলেন সঞ্চয়বাবু। কাজীসাহেব, মজফ্ফর আহমেদ বা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়েরা কোন টেবিলটায় বসতেন, বহু বার দাদু সেটা দেখিয়েছেন।
আরও পড়ুন: একই নায়ক, দুই প্রজন্মের দৃষ্টি, বাঙালি সংস্কৃতি-পরম্পরার মুখ
দাদুর মুখে শোনা একটি ঘটনার কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়! ‘ফেভারিট কেবিন’ তখন স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের আড্ডা। নূতনচন্দ্র মুখচোরা, নির্বিবাদী। কিন্তু শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তরুণদের জন্য ফেভারিটের অবারিত দ্বার। বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, হরিশ শিকদারের দলের ছেলেদের আনাগোনা লেগেই থাকত। তখন লম্বাটে চা-ঘরের ভিতরটা তিন ভাগ করা। পুলিশ ঢুকলে ইশারায় নির্দেশ চলে যেত। পিছনে বাথরুমের পাশে একটা খিড়কির দরজা দিয়ে বিপ্লবীরা মুহূর্তে পগারপার। কিন্তু সে বার টেগার্ট সাহেব একা এসেছিলেন। তাঁকে দেখে সবাই পালালেও এক জন বাড়ির কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে টেগার্ট তাঁকে ধরে ফেলেন। মারতে মারতে হিঁচড়ে দোকানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময়েই ছেলেটি হার্টফেল করেন। প্রবীণ বয়সেও সেই মৃত্যুর ঘোর লেগে থাকত নূতনচন্দ্রের চোখে।
শিবরাম চক্রবর্তীকে নিজেও দেখেছেন সঞ্চয়বাবু। পছন্দের টেবিল না-পেলে ‘দেলখোসে যাই’ বলে দিলখুসায় কাটলেট খেতে চলে যেতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের রূপের মতো প্রাণখোলা হাসির গল্পও সঞ্চয়বাবুর ছেলেবেলার রূপকথা ছিল। দাদু বলতেন, ছেলেটার সশব্দ হাসি বাইরে থেকেও স্পষ্ট শোনা যেত।
কল্লোল যুগের সাহিত্যিকদের সঙ্গে আড্ডার একটা দৃশ্য ধরতে তাঁর ‘একটি জীবন’ ছবিতে রাজা মিত্র অনিবার্য ভাবেই ফেভারিটে শুটিং করেন। ‘‘প্রথম দিন এক জন ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট কোনও সুইচে শক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সৌমিত্র এবং বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে চায়ের টেবিলে বসিয়ে পরদিন শট নিই।’’— বললেন রাজা। সেই শুটিং সঞ্চয়বাবুও দেখেছেন। সৌমিত্রবাবু লিখেছেন, কফি হাউস তাঁদের যৌবনের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র হলেও তার গুরুত্বপূর্ণ উপগ্রহ ফেভারিট, ওয়াইএমসিএ, বসন্ত কেবিন। কফি হাউসের পরে ফেভারিটই ‘ফেভারিট’। সঞ্চয়বাবু সগর্বে বলেন, ‘‘ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে সংবর্ধনা নিতে এসে পাঁচ মিনিট ধরে আমাদের কথা বলেন সৌমিত্র।’’
ইতিহাসের চা-টোস্টের সেই উত্তাপ আপাতত থিতিয়ে বসুমল্লিকদের জরাজীর্ণ বাড়িটায়। ‘ফেভারিট কেবিন’ সাইনবোর্ডটা শুধু কলকাতার গত জন্মের গল্প বলে চলেছে।