নিজেদের তৈরি ব্যান্ডেল চিজ় নিয়ে পলাশ ঘোষ। ছবি: সৌরভ গুপ্ত
এমন চিজ়-সূত্র নিয়ে অনায়াসে নামতে পারে কোনও ‘বেস্টসেলার থ্রিলার’। নিউ মার্কেট তল্লাটে কয়েক শতকের পুরনো ধোঁয়াগন্ধের এমনই মহিমা।
কয়েক বছর আগে আমেরিকার ব্লুমবার্গ সংস্থার ডাকে বিশ্বের তাবড় শেফদের পছন্দের চিজ়ের তালিকায় কুলীন ১০-১২টি চিজ়ের মধ্যে ঠাঁই করে নেয় এই ব্যান্ডেল চিজ়। নামে ব্যান্ডেল। এটুকু জানা যায়, ব্যান্ডেল তল্লাটে ওলন্দাজ পাদ্রীদের শৈলী রপ্ত করেই ছানার সন্দেশের মতো এই চিজ়েরও জন্ম হয়েছিল। তবু এমন চিজ়ের আজকের আঁতুড় বা লালনভূমি ঘিরে এখনও গভীর রহস্য। সারা দুনিয়ায় নামডাক ছড়ালেও তা একান্তই কলকাতার সাবেক হগ সাহেবের বাজারের সম্ভার বলেই চেনা।
বাংলার এই উৎকর্ষ চিজ়-ঐতিহ্য রক্ষায় রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের একটি প্রকল্পের কাজে এত দিনে সেই চিজ়-রহস্যের জট খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকল্পটির ভার নিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। কিন্তু দু’বছর ধরে ব্যান্ডেল চিজ়ের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেও তাদের পক্ষে এই চিজ়ের উৎপাদনস্থলটি খুঁজে বার করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু বিচিত্র যোগাযোগের সুবাদে সেই রহস্য একটু হলেও ফিকে হচ্ছে। প্রকল্পটির নির্দেশক দেবব্রত বেরার কথায়, “যা জানা যাচ্ছে, আরামবাগের দিকে একটি গ্রামে একটি মাত্র পরিবার এই ব্যান্ডেল চিজ় তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে। তারাই নিউ মার্কেটে চিজ় সরবরাহ করে এবং সেখান থেকেই তা দেশ-বিদেশের নামী শেফ বা চিজ়-রসিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।’’
এই পরিবারটিকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেবব্রতবাবু দিচ্ছেন সৌরভ গুপ্ত নামে খাদ্যপ্রেমী এক আইনজীবীকে। সৌরভবাবু দিল্লিতে থাকেন। কলকাতাতেও খাদ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত কিছু কাজের তিনি শরিক। সৌরভবাবুর সূত্রে নিতান্তই প্রচারবিমুখ চিজ় উৎপাদক ওই পরিবারের এক তরুণ সদ্য যাদবপুরে সংশ্লিষ্ট বিভাগে দেবব্রতবাবুদের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। তবে পলাশ ঘোষ নামে ওই তরুণ তাঁর গ্রামের হদিস এখনও ফাঁস করতে রাজি নন। সৌরভবাবুর কথায়, ‘‘ওঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, সরকারি সাহায্য এলে চিজ়টার প্রসারে কত সুবিধা হবে।’’
দেবব্রতবাবু এবং সল্টলেকের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপিকা লক্ষ্মীশ্রী রায়ের তত্ত্বাবধানে গবেষণায় এত দিনে ব্যান্ডেল চিজ়ের উপযোগিতার নানা দিক উঠে এসেছে। দেবব্রতবাবু বলছেন, “এর মধ্যে অনেক উপকারী ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে। যা পেটের কিছু জটিল রোগ সারাতে পারে। তবে এই চিজ় তৈরির প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি শুধরানো দরকার। তা না হলে বিদেশে টিন-বন্দি পণ্য হিসেবে সরকারি স্তরে এর বিপণনে সমস্যা হবে।”
সাদা এবং বাদামি রঙে কাঁচাগোল্লা সন্দেশের আদলের এই চিজ় ঈষৎ নোনতা। কিন্তু এর ধোঁয়াগন্ধ বা বিশিষ্ট স্মোকি স্বাদের টান অনেক নামজাদা শেফেরই প্রিয়। অভিজ্ঞরা জানেন, এই চিজ়খণ্ডের নোনতা ভাব কাটাতে রাতভর জলে ভিজিয়ে রাখা দস্তুর। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারে কয়েক প্রজন্ম ধরে জারি এই ব্যান্ডেল চিজ়ের কদর। কলকাতার বিশিষ্ট শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায় বা চিরঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়দের নানা নিরীক্ষায় ব্যান্ডেল চিজ় বার বার গুরুত্ব পেয়েছে। লকডাউনের আগে দিল্লিতে কলকাতার আর্মেনিয়ান ঘরানার একটি রেস্তরাঁয় সব রান্নাই স্রেফ বাংলার কালিম্পং চিজ় এবং ব্যান্ডেল চিজ়ে সারতেন শেফ তথা কর্ণধার সব্যসাচী গরাই। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার শোভন রায়ের কথায়, “এই ধরনের ঘরোয়া কিন্তু স্থানভিত্তিক উৎকর্ষ পণ্য নিয়ে গবেষণা জরুরি। আরও তথ্য পেলে ব্যান্ডেল চিজ়ের জন্যও জিআই তকমা আদায় করা সম্ভব।’’