ঐতিহ্য: বীরাষ্টমীতে লাঠিখেলার প্রদর্শন।
দু’জনেরই বয়স আশি পেরিয়েছে। সারা বছর তাঁরা কী করেন, কোথায় থাকেন, নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। যোগাযোগের উপায়ও নেই। কারণ, দু’জনের কারও ফোন নেই। যত দূর জানা যায়, এক জনের বাড়ি বাগবাজার চত্বরেই, অন্য জন বরাহনগরের কোনও এক ক্লাবে রাতে ঘুমোন। পরিবার বলতেও তেমন কেউ নেই। সম্পত্তি বলতে একটি লাঠি। দিনভর সেই লাঠি নিয়েই কসরত চলে তাঁদের। কিছু বলতেও হয় না, প্রতি দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর সকাল সকাল লাঠি কাঁধে নিয়েই তাঁরা পৌঁছে যান বাগবাজার স্ট্রিটের মণ্ডপ চত্বরের বীরাষ্টমী উৎসবে।
দুই অশীতিপর পাঁচুগোপাল শ্রীমানী এবং হারাধন চক্রবর্তীর জীবনের এটাই গত পঞ্চাশ বছরের রীতি। দাপুটে লাঠিয়াল এই দু’জনকে নিয়ে আপাতত চিন্তায় ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী’-র উদ্যোক্তারা। কারণ করোনার জন্য এ বছর আদালতের নির্দেশে দর্শকশূন্য হতে চলেছে দুর্গাপুজো। সেই সঙ্গে ছেদ পড়ছে বাগবাজারের শতবর্ষ পুরনো বীরাষ্টমী উৎসবে। ভিড় এড়াতে অবশ্য আগেই লাঠি খেলা, ছুরি খেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। সেই খবর অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলিকে জানানো হলেও, ওই দু’জনকে কী ভাবে জানাবেন, তা-ই ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা। পুজো কমিটির তরফে বীরাষ্টমীর দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবযানী মুন্সী বলছিলেন, “কেউ আসুন আর না আসুন, এই দু’জন আসতেনই। আসলে এখানে যাঁরা খেলা দেখান, তাঁরা ফুল নিয়ে মন্ত্র বলে অঞ্জলি দেওয়ায় বিশ্বাস করেন না। দেবীর সামনে অস্ত্রের খেলা দেখানোকেই তাঁরা অঞ্জলি দেওয়া বলে মনে করেন। এ বার বীরাষ্টমী বন্ধ থাকছে শুনে ওঁদের অনেকেই বলছেন, ‘‘এ বার তা হলে অঞ্জলিটাই দেওয়া হবে না!”
অংশগ্রহণকারীদের কথাতেও বীরাষ্টমী ঘিরে রয়েছে জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের গন্ধ। এমনই এক অংশগ্রহণকারী তথা ‘বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি’র সহকারী সচিব কৌশিক মজুমদার জানান, সরলাদেবী চৌধুরানী রাজা প্রতাপাদিত্যের নামে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ চালু করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু চালু করেন বীরাষ্টমী উৎসব। আগে এই বাগবাজারের পুজো রাস্তায় হত। ১৯১৮ সাল থেকে সেখানেই বীরাষ্টমী উৎসবের শুরু। অষ্টমীর অঞ্জলির পরে মণ্ডপের সামনে লাঠি খেলা, তরোয়াল খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তির মতো দেশজ খেলা হত। কলকাতার মেয়র থাকাকালীন বাগবাজারের পুজো এখনকার মাঠে করার অনুমতি দেন সুভাষচন্দ্র বসুই। তার পর থেকে মাঠেই হয় এই বীরাষ্টমী উৎসব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলার তালিকায় জুড়েছে জুডো, ক্যারাটে, বক্সিংও। কৌশিকবাবু বলেন, “সাহেবরাই শক্তিমান, বাঙালি ভীরু, দুর্বল, এই বিশ্বাস ভাঙতেই বীরাষ্টমীর উদ্যাপন। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস নিজে থাকতেন সেই উৎসবে। এখন যান তাঁর নাতি বিশ্বরঞ্জন দাস।” প্রতি বছর অংশ নেওয়া অন্য একটি সংস্থা, অভেদানন্দ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বর্ষীয়ান সদস্য বাদলকুমার রক্ষিত আবার বললেন, “শুনেছি, বীরাষ্টমীতে জনতার ভিড়ে মিশে যেতেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী সদস্যেরা। জনসংযোগের এমন সুযোগ হারাতে চাইতেন না তাঁরা।”
তাঁর আক্ষেপ, “ইতিহাসকে না জানা বা জানতে না দেওয়ার যে সময়ে চলেছি, সেখানে ছেলেমেয়েরা মোবাইলেই মারামারি করতে পছন্দ করে। ঘাম ঝরাতে চায় না। বীরাষ্টমী উৎসবের অঙ্গ হতে যে অনুশাসন দরকার, তা কত জনের আছে?” বিশ্বরঞ্জনবাবুর কথায়, “ভারতের বৈপ্লবিক ইতিহাসের থেকে বিদেশের ইতিহাস ছেলেমেয়েদের পড়তে দিয়ে আমরা বেশি আনন্দ পাই।” তাঁর প্রশ্ন, “আদালতের নির্দেশে দর্শকশূন্য পুজো স্বাগত। কিন্তু অন্য সব কিছু দূরত্ব-বিধি মেনে পালন করা গেলে বীরাষ্টমী উৎসব করা যাবে না কেন?’’
যা শুনে বাগবাজার সর্বজনীনের সম্পাদক গৌতম নিয়োগী বললেন, “একটা সমস্যা হতে পারে ভেবেই বীরাষ্টমী বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে, পুজোটাই দর্শকশূন্য হয়ে গেল। আমরা আগাম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা ঠিকই ছিল।’’