নিজস্ব চিত্র।
তখনও ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ শব্দটি যুক্ত হয়নি মন্ত্রকের সঙ্গে। মন্ত্রকের নাম ‘পরিবেশ ও বন’ মন্ত্রকই ছিল। সময়টা ২০০০ সালের অগস্ট মাস নাগাদ।
দেশের শব্দদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, মাস ছয়েক আগেই (ফেব্রুয়ারি, ২০০০) যেখানে ‘দ্য নয়েজ় পলিউশন (রেগুলেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল) রুলস, ২০০০’ জারি হয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে দেশের বিভিন্ন শহরের শব্দদূষণ পরিস্থিতি ঠিক কেমন?
পরিবেশ মন্ত্রকের তথ্য জানিয়েছিল, ক্যালকাটা (তখনও কলকাতা হয়নি), মুম্বই, চেন্নাই এবং ব্যাঙ্গালোর (তখন বেঙ্গালুরুও হয়নি, তা হয় ২০১৪ সালে), দেশের এই চারটি মেট্রোপলিটন শহরের দিনে বা রাতে শিল্পক্ষেত্র বা বসতি, সব সময়ে এবং সর্বত্রই শব্দের দাপটে ‘ক্যালকাটা’ এগিয়ে। বসতি এলাকার ক্ষেত্রে দিন ও রাতে মুম্বই, চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালোরের শব্দমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭০ ও ৬২, ৬৬ ও ৪৮ এবং ৬৭ ও ৫০ ডেসিবেল, সেখানে এই শহরে তা ছিল যথাক্রমে ৭৯ (দিন) এবং ৬৫ (রাত) ডেসিবেল।
সময়ের স্রোতে ‘ক্যালকাটা’ ‘কলকাতা’ (২০০১ সালে) হয়েছে। কিন্তু থেকে গিয়েছে শব্দ-ত্রাস! তাই গত বছরও কেন্দ্রের তথ্য তালিকায় এসএসকেএম এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন ‘সাইলেন্স জ়োন’ এলাকায় নির্ধারিত শব্দমাত্রা (দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবেল) ধারাবাহিক ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ওই দুই এলাকায় রাতে শব্দমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৬০ ও ৪১, ৭১ ও ৬০ এবং ৭০ ও ৬২ ডেসিবেল! যার পরিপ্রেক্ষিতে শব্দদূষণ রোধে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে অতীতে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য, ইএনটি চিকিৎসক দুলাল বসু আক্ষেপের সুরে বলছেন, ‘‘মানুষ কোভিড-বিধিই মানছেন না, সেখানে শব্দবিধি কী ভাবে মানবেন?’’ রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী রত্না দে নাগের কথায়, ‘‘মানুষ সচেতন না হলে আইন করে কতটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?’’
যার ফল, শুধু কালীপুজোয় নয়, বরং সারা বছর ধরেই শহরে দাপাচ্ছে এই শব্দ-ত্রাস। এ জন্য পুলিশ প্রশাসনের গয়ংগচ্ছ মনোভাব ছাড়াও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঔদাসীন্যকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞেরা। সরকারি নথি বলছে, কলকাতার একাধিক রাস্তার শব্দপ্রাবল্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ১৯৯০-২০১০ সাল, এই দুই দশকে একাধিক বার (’৯৩, ’৯৪, ’৯৯ ও ’০৪ সাল) সমীক্ষা চালিয়েছিল। ২০০৫-’০৬ সালে শ্যামবাজার, উল্টোডাঙা, গিরিশ পার্ক, মৌলালি, তারাতলা মোড়, যাদবপুর-সুলেখা, বেহালা ১৪ নম্বর বাসস্ট্যান্ড, গড়িয়া মোড়-সহ একাধিক জায়গাকে পর্ষদের তরফে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘হেলথ ইমপ্যাক্ট সার্ভে’-র জন্য। সংশ্লিষ্ট এলাকার ৩৮ শতাংশ বাসিন্দা জানিয়েছিলেন, তাঁরা গাড়ির হর্নে তিতিবিরক্ত। ৭১ শতাংশ বাসিন্দা জানান, গাড়ির তীব্র আওয়াজে তাঁরা ঠিক মতো ঘুমোতে পারেন না!
অবস্থা কি একটুও পাল্টেছে?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, শব্দদূষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট, কলকাতা হাই কোর্ট, জাতীয় পরিবেশ আদালতের সক্রিয়তায় পরিস্থিতি আগের মতো না থাকাটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ভরসা করার মতো পরিস্থিতি যে তৈরি হয়নি, তা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝছেন মানুষ। যেমন, হাওড়ার আন্দুলের বাসিন্দা সহেল পল্যে। বি-টেক পাশ করে বর্তমানে চাকরিপ্রার্থী সহেলের শ্রবণশক্তি ২০১৯ সালের কালীপুজোয় শব্দবাজির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বর্তমানে সুস্থ হয়ে ওঠা সহেল বলছেন, ‘‘সব সময়ে কানে ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ হত। এক বছর ধরে একটানা ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছি।’’ যাঁর চিকিৎসায় সহেল সুস্থ হয়েছেন, সেই ইএনটি চিকিৎসক শান্তনু পাঁজা বলছেন, ‘‘কালীপুজো হোক বা অন্য সময়, শব্দদূষণ রোধে রাজনৈতিক নেতাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।’’
কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের (২০১৪ সালে পরিবেশ, বনের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন যুক্ত হয়) কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ, লখনউ, কলকাতা ও মুম্বই শহরের শিল্প, বাণিজ্যিক, বসতি এবং শব্দহীন এলাকার তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শব্দ শাসনের নিরিখে কলকাতা প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রথম সারিতে রয়েছে। যেমন ২০১৫ সালে সাতটি শহরের ১২টি শিল্প এলাকায় শীর্ষে ছিল কলকাতার গোলপার্ক। ২৫টি বাণিজ্যিক এলাকার শীর্ষে ছিল নিউ মার্কেট চত্বর। ১৬টি বসতি এলাকার মধ্যে বাগবাজার ছিল দ্বিতীয় স্থানে, দিল্লির পঞ্জাবি বাগের পরেই। প্রায় একই ধারা বজায় থাকে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেও।
বছরের সাধারণ সময়েই শহরে শব্দ-দাপটের যেখানে এই অবস্থা, সেখানে এক শ্রেণির মানুষের কাছে কালীপুজো বা দীপাবলি শব্দবিধি ভাঙার যে অলিখিত ‘লাইসেন্স’ হবে, এতে আশ্চর্য কোথায়! সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দীপাবলির আগের দিন ও দীপাবলির দিন দক্ষিণ কলকাতার কসবা (শব্দদূষণের হটস্পট) শব্দমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫৫ ও ৭০ ডেসিবেল এবং ৫৭ ও ৫৯ ডেসিবেল। যদিও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানাচ্ছে, চলতি বছরের কালীপুজোয় আগের তুলনায় শব্দবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ অনেক কম এসেছে। কালীপুজো ও তার আগের দিন (৪ ও ৩ নভেম্বর) মিলিয়ে ৫০টি অভিযোগ দায়ের হয়। সব ক’টিই ছিল শব্দবাজি সংক্রান্ত। যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘পুলিশ শব্দবিধি লঙ্ঘন হলেও শুনতে পায় না!’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘শব্দ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য চলছে।’’
এই পরিস্থিতিতে আরও একটি নির্বাচনের মুখোমুখি শহর। ফের মাইকে গগনভেদী প্রচার, সমর্থকদের গলা ফাটানো চিৎকার, গাড়ি ও মোটরবাইক দাপানো উৎসব চলবে। সমর্থিত দল জিতলে তো কথাই নেই! সেই শব্দস্রোতে আবারও হারিয়ে যাবে ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’-এর আকুতি!