গোবিন্দ হাজরা। ছবি ফেসবুক।
তাঁর বিরুদ্ধে অত্যাচারের ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠলেও প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পেতেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ, তিনি ছিলেন এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলত স্থানীয় থানা, পঞ্চায়েত ও প্রশাসন। তিনি চাইলে পাবেন না, এমন কথা কেউ বললে তাঁর কপালে জুটত মারধর, হুমকি। এমনকি, কোনও পরিবারের জমি দখল করতেও মুহূর্তমাত্র সময় লাগত না তাঁর। আক্ষরিক অর্থেই এলাকার ‘রাহু’ হয়ে ওঠা, হাওড়ার জগদীশপুরের প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান গোবিন্দ হাজরাকে গ্রেফতারের পরে তদন্তে নেমে পুলিশের হাতে উঠে এসেছে এমনই সব তথ্য। যা নিয়ে ফের নতুন করে মামলা রুজু করার কথা ভাবছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ জানতে পেরেছে, দীর্ঘ ১৮ বছর পঞ্চায়েত প্রধান থাকাকালীন গোবিন্দ যে শুধু জমি বা সম্পত্তিই দখল করেছিলেন তা নয়। নিজস্ব ‘গুন্ডাবাহিনী’ও তৈরি করেছিলেন তিনি, যাদের নানা অসামাজিক কাজে লাগানো হত। এই নিয়ে অসন্তোষ ছিল বাহিনীর অন্দরেই। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালে আগে সেই খবর পৌঁছত গোবিন্দের কাছে। অত্যাচার আর হুমকির মুখে পড়তে হত খোদ অভিযোগকারীকেই।
ঠিক যেমন হেনস্থার মুখে পড়েছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী সূর্য মণ্ডল। জগদীশপুরের নতুন বিশ্বাসপাড়ায় তিন বিঘা জমিতে নিজের বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন গোবিন্দ। সূর্যবাবুর অভিযোগ, সেই বাগানবাড়ির জমি উঁচু করতে তাঁর বাড়ির পাঁচিল ভেঙে মাঠ করে দিয়েছিলেন গোবিন্দ নিজে। লুটপাট চালিয়ে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল কারখানা। এর পরে সেই জমি থেকে মাটি কেটে পুকুর তৈরি করে তা দিয়ে নিজের বাগানবাড়ির জমি উঁচু করেছিলেন গোবিন্দ।
সূর্যবাবু বলেন, ‘‘ওর নামে জমি লিখে না দিলে আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল গোবিন্দ। ভয়ে মেয়েকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিই। এই অভিযোগ জানিয়ে লিলুয়া থানায় ৫২টি ডায়েরি করেছিলাম। কিন্তু কিছু হয়নি।’’
গত বছর আমপানে কারখানার ছাউনি উড়ে গিয়েছিল জগদীশপুরেরই বাসিন্দা গোবর্ধন নস্করের। তাঁর রুটিরুজি জোটাত সেই গ্রিলের কারখানা। অভিযোগ, ‘দাদা’কে নজরানা না-দিয়ে সেই ছাউনি মেরামত করতে যাওয়ায় কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল গোবর্ধনবাবুর গোটা পরিবারকে। গোবর্ধনবাবুকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠেছিল গোবিন্দের বিরুদ্ধে। পাঁচ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন গোবর্ধনবাবু। পুলিশের থেকে সাহায্য না পেয়ে জেলাশাসকের বাংলোর কাছে সস্ত্রীক ধর্নায় বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
গোবর্ধনবাবু বলেন, ‘‘কারখানাটাই ছিল আমার রোজগারের একমাত্র পথ। সেটা দীর্ঘ দিন বন্ধ হয়ে পড়েছিল। প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরেও সাহায্য পাইনি।’’ পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, সমস্ত পুরনো অভিযোগের ফের তদন্ত হবে। যে সব আইনি ব্যবস্থা আগে নেওয়া হয়নি, তা নেওয়া হবে।
এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, প্রধান থাকাকালীন গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ ছিলেন না। শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয়েরাই তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রতিবাদ-মঞ্চ তৈরি করেন। ‘নাগরিক সমাজ’ নামে সেই মঞ্চের সম্পাদক শুভ্রকান্তি বসুরায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা প্রকাশ্যে সভা করে পঞ্চায়েত প্রধানকে এলাকাছাড়া করার দাবি তুলি। সমস্ত অত্যাচারিত ব্যক্তি ও পরিবারকে একত্র করি। আমরাই বলি, উনি জগদীশপুরের ‘প্রধান রাহু’। এলাকায় ওঁর থাকার অধিকার নেই।’’