প্রতীকী ছবি।
সাতসকালের হোয়াটসঅ্যাপ-বার্তাটি বাংলায় ‘বিশৃঙ্খলা’র ছবি তুলে ধরে নাগরিক ভোগান্তির সচিত্র সাতকাহন ফেঁদেছিল গলার শিরা ফুলিয়ে। বিকেলের মধ্যে একটু অনুসন্ধান করতেই কিন্তু ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ল অন্য বেড়াল।
দেখা গেল, সকালের বার্তায় যে জ্বলন্ত ট্রেনের ছবিটি ছড়ানো হয়েছিল, তা আদতে গত বছরের মে মাসে নয়াদিল্লি-বিশাখাপত্তনম ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ছবি। আর ওই যে রক্তাক্ত শিশুর ছবি, যা দেখিয়ে বলা হয়েছিল, এই বিক্ষোভ বা বিরোধিতাকে সমর্থন করলে আপনি ক’জন নিষ্ঠুর নরপশুর সমগোত্রীয়, তা আসলে বাংলাদেশের একটি দুর্ঘটনার ছবি। এই বাংলায় নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় যা হচ্ছে, তার দিকে আঙুল তুলতে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় জখম একটি শিশুর ছবিকে তাস করা হয়েছে।
কয়েকটি টুইট বা হোয়াটসঅ্যাপ-বার্তায় ভুয়ো ছবি দিয়ে আবার ১৯৪৬-এর ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নিয়ে আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ভুয়ো খবর বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানে উঠে আসছে ইন্টারনেটে এমনই অজস্র মিথ্যাচারের গল্প। আজকের যুগে এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। এর আগে বসিরহাটে গোলমালের সময়ে নারী-নিগ্রহের ভুয়ো গল্প ফাঁদতে ভোজপুরি সিনেমার দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। আসানসোলের গোলমালের সময়ে দেখা গিয়েছিল নাইজিরিয়ার জাতি-সংঘর্ষের ছবিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। একই কায়দায় এ বারও উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর খেলা চলছে। হযবরল-র সুকুমারীয় কল্পনাকেও যা হার মানিয়ে দিয়ে রুমাল থেকে হয়ে যাচ্ছে বেড়াল।
আরও পড়ুন: মৌলালির মোড়ে বাংলাদেশি ক্যানসার রোগীর ২০ হাজার টাকা ‘ছিনতাই’, অভিযুক্ত পুলিশই!
লালবাজারের এক কর্তার মতে, ‘‘এই ভুয়ো ছবি ছড়ানোর পিছনে প্রধানত দু’টি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে জনজীবন আরও টালমাটাল করা। দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদের চরিত্রটিকে যত দূর সম্ভব নিষ্ঠুর ও নেতিবাচক ভাবে মেলে ধরে এক ধরনের ঘৃণা ছড়ানো।’’ পুলিশ ও সাইবার আইন বিশারদদের মতে, এই ধরনের ছবি বা মিম তৈরিই শুধু নয়, তা ছড়ানোও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুজব কিংবা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বার্তা প্রচারের অভিযোগে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হতে পারে। এই ধরনের অপপ্রচার রুখতে ইতিমধ্যেই রাজ্যের কয়েকটি এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষপাতী প্রশাসন।
এ রাজ্যে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় যাঁরা নেমেছেন, মিথ্যাচারের নিশানায় শুধু তাঁরাই আছেন, এমনটা নয়। দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদকেও বিকৃত ভাবে মেলে ধরা হচ্ছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিজেপি-র কয়েক জন সর্বভারতীয় স্তরের কর্মকর্তাকেও দেখা গিয়েছে, বিতর্কিত বা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছবি টুইট করতে। সে সব ছবি বারবার রিটুইট হয়ে চলেছে। যেমন, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লোগান দেওয়া পড়ুয়াদের ছবি দিয়ে তাতে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগ তোলা হয়েছে। কোলাহলের মধ্যে অস্পষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতিবাদ বা রাজনীতির হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী স্লোগানকে হিন্দু-বিরোধী লব্জ বলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন: এ দেশ ছেড়ে কোথায় যাব, প্রশ্ন মেটিয়াবুরুজের দর্জিদের
টুইটারে মুসলিম বলে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে নয়া নাগরিকত্ব আইনকে সমর্থন করেও বিবৃতি ছড়ানো হচ্ছে। ভুয়ো পরিচয়ে বলা হচ্ছে, ‘আমিও মুসলিম। কিন্তু নয়া নাগরিকত্ব আইন সমর্থন করি। যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা ভুল বুঝছেন বা ভুল বোঝানো হচ্ছে।’
ভুয়ো খবর শনাক্ত করার একটি ওয়েবসাইট অল্ট নিউজ়ের অনুসন্ধানে এমন কারসাজির বেশ কিছু নমুনা এসেছে। অল্ট নিউজ়ের তরফে বলা হয়েছে, খাদিজা নামের একটি টুইটার প্রোফাইলকে আগে ‘অর্পিতা গৌতম’ বলে টুইট করতে দেখা গিয়েছে। একই ভাবে ‘দেহাতি ইন্টেলেকচুয়াল’-এর পুরনো টুইট ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, তিনি আগে নিজের হিন্দু পরিচয়ের কথাই বলছেন। লালবাজারের এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘যাবতীয় অপপ্রচার কিন্তু সংগঠিত ভাবে চালানো হচ্ছে। এ সবই পাকা মাথার কাজ বলে মনে হচ্ছে।’’