মেয়েদের স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র থেকে গার্হস্থ্য— ভোটের ইস্তাহারে হয়তো ঠাঁই পায়, কিন্তু বাস্তবে?
sexual harassment

আইনে ভরসা নেই, নীরবেই কর্মরতারা

২০১২-য় দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের পরে নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ২০১৩-য় ‘দ্য সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অব উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস’-এর মতো আইন প্রণয়নের পরেও ছবিটা বদলায়নি। ব

Advertisement

সুনীতা কোলে

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪৯
Share:

জীবনের প্রথম চাকরিতে ঢোকার পরে সবে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ হতে শুরু করেছে এক তরুণীর। কিছু দিন যাওয়ার পরেই বয়োজ্যেষ্ঠ এক পুরুষ সহকর্মী তরুণীর পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। প্রথমে কৌতূহলবশত তিনি প্রশ্ন করছেন ভাবলেও তরুণীর বিবাহিত জীবন নিয়ে ধেয়ে আসতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন। সহকর্মীর প্রশ্ন যে এ ভাবে অস্বস্তির কারণ হবে, তা নিয়ে ধারণাই ছিল না তরুণীর। এমন হলে কী করা উচিত, তা-ও বুঝে উঠতে পারেননি ওই তরুণী। বিষয়টি ক্রমশ শালীনতার মাত্রা ছাড়াতে থাকায় ওই সহকর্মীকে এড়িয়ে যেতে শুরু করেন তিনি।

Advertisement

এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি, কর্মরতাদের মধ্যে তেমন কাউকে পাওয়া কার্যত কঠিন। তবে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মুখোমুখি হয়েও বেশির ভাগই চুপ করে থাকেন নানা কারণে। ইন্ডিয়ান বার অ্যাসোসিয়েশনের ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মহিলাই অভিযোগ জানাতে চান না। ২০১২-য় দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের পরে নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ২০১৩-য় ‘দ্য সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অব উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস’-এর মতো আইন প্রণয়নের পরেও ছবিটা বদলায়নি। বণিকসভা ফিকি-র একটি সমীক্ষা বলছে, ভারতে অফিস রয়েছে এমন দেশীয় সংস্থার ৩৬ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ বহুজাতিক সংস্থায় নেই ইন্টারনাল কমপ্লেন্টস কমিটি (আইসিসি)। ওই সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা আইনি ধারণা নেই।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মধ্যে কী কী পড়ে? রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ধর্ষণ, গায়ে হাত দেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই যৌন হেনস্থার মধ্যে পড়ে। এর বাইরেও ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, যৌনগন্ধী ভিডিয়ো দেখানো বা আলোচনা, লিঙ্গের ভিত্তিতে কটূক্তি— হেনস্থার মধ্যে পড়ে সবই। আর অফিসের কাজে কোথাও গেলে বা অফিসের দেওয়া পরিবহণে হেনস্থার শিকার হলেও তা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার আওতায় পড়বে। সুনন্দা জানাচ্ছেন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীরা অনেক বেশি সংখ্যায় নিয়মিত হেনস্থার শিকার হন।
কেন অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসেন মেয়েরা?

Advertisement

অধ্যাপিকা ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের মতে, হেনস্থা যাঁরা করেন, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতার জায়গায় থাকেন। অশালীন আচরণ করেও পার পেয়ে যাবেন, সেটা জেনেই তাঁরা এমন করেন। তাই অভিযোগ করলে চাকরির ক্ষতি হবে, এই ভেবে অনেকে পিছিয়ে আসেন। একই কারণে অভিযোগ জানানোর পরে আরও হেনস্থার মুখোমুখি হওয়ার ভয় থাকে। আবার অনেক সময়ে নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তেও অবিশ্বাসের মুখোমুখি হতে হয়, কারণ নির্যাতিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করার প্রবণতা চলে আসছে। শাশ্বতী বলেন, ‘‘অভিযোগ করলেও খুব কম ক্ষেত্রে অভিযুক্তের শাস্তি হয়। রিপোর্ট আটকে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় খুব বেশি। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে জেলাশাসকের অধীনে লোকাল কমপ্লেন্টস কমিটি তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও হাতে গোনা জায়গায় সেটা হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা জীবিকা হারানোর ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করছেন সব। আসলে আইনি পথে সমাধানের পদ্ধতিটা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মিটু জাতীয় আন্দোলনের জন্ম হচ্ছে।’’

তবে অনেক সংস্থাই এখন বিষয়টি নিয়ে যত্নবান হয়েছে বলে জানাচ্ছেন মানবসম্পদ উন্নয়ন পরামর্শদাতা বীর্যেন্দু গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ঠেকানোর ব্যবস্থা থাকা বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে এখন সম্মানের ব্যাপার। আগের থেকে এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। কর্মীদের নিয়ে কর্মশালা করানো হয়। নাম ছাড়াই চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা থাকে। কর্তৃপক্ষ এবং অভিযোগকারিণী, দু’পক্ষকেই যত্নবান হতে হবে। আর কমিটিকেও নিরপেক্ষ ভাবে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে।’’

ভোট আসতেই মহিলাদের জন্য প্রতিশ্রুতির বন্যা। পরিবারের কর্ত্রীর হাতে বার্ষিক ভাতা, সরকারি বাসে মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে যাতায়াত, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বাড়তি সুবিধার আশ্বাস দিয়ে ভোট টানার প্রতিযোগিতা তুঙ্গে। কিন্তু মেয়েরাও কি এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাসী? কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার মুখোমুখি হওয়া এক তরুণী বলেন, ‘‘কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা যাতে কাজটা মন দিতে পারেন, সেই জায়গাটা তৈরি করা হোক। বাস্তবেও আইনের প্রয়োগ হোক। সরব হোন জনপ্রতিনিধিরাও। বাকিটা মেয়েরা তাঁদের যোগ্যতা দিয়ে আদায় করে নেবেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement