জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশনস্থলে শামিল হন হাজার হাজার মানুষ। —ফাইল চিত্র।
এ যেন এক মিশ্র দিন শহরে। মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড়ের মধ্যেই সুর কাটল কিছু জায়গায়। নিরঞ্জনের জন্য গঙ্গা অভিমুখে চলল বাড়ির প্রতিমা। দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে প্রতিমা দর্শনের ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই ফিরতে হল কাউকে কাউকে। বহু জায়গায় আবার সিঁদুর খেলা শুরু হল বিসর্জনের আগে ‘উৎসবের’ শেষ দিকের কর্মসূচি হিসাবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, দুর্গোৎসবের শেষের সময় যত এগিয়ে এল, ততই ভিড় বাড়ল আর এক কর্মসূচিতে— ধর্মতলায়।
জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশনস্থলে দুপুর থেকেই শামিল হতে শুরু করলেন হাজার হাজার মানুষ। সন্ধ্যার পরে সেই ভিড় এক প্রকার জনপ্লাবনের চেহারা নিল। সেখানে মণ্ডপ ঘুরতে বেরোনো জনতার দেখা যেমন মিলল, তেমনই হাজির হলেন প্রচুর সিঁদুর-মাখা মুখও। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘বাড়ির পুজোর দায়িত্ব পালনের মধ্যেই প্রতিদিন এসেছি। পুজো আর আন্দোলনের বিরোধ নেই, সেই বার্তা মনে রেখেই চলেছি এই ক’দিন। আজ, গঙ্গায় বাড়ির দেবীর বিসর্জন দিয়েই আর এক দেবীর অধিকারের লড়াইয়ের উৎসব-যাপনে চলে এসেছি।’’
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের দুর্গাপুজো কেমন কাটবে, তা নিয়ে নানা মহলে চর্চা চলছিল। তবে গত কয়েক দিনে দেখা গিয়েছে, মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড়ের মধ্যেই চলেছে সুবিচারের দাবিতে প্রতিবাদ-আন্দোলন। শনিবারও তার অন্যথা হয়নি। মিছিলের পাশাপাশি,
শহরের বেশ কিছু জায়গায় হয়েছে অবস্থান-বিক্ষোভ। এর মধ্যে ভিড়ও উপচে পড়েছে মণ্ডপে মণ্ডপে। সকাল থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা ভিড় বাঁধভাঙা চেহারা নিয়েছে
রাত ১০টার পর থেকে। প্রতি বারের মতোই উত্তর বনাম দক্ষিণের ভিড়ের লড়াই দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ কালচারালের উদ্যোক্তা অঞ্জন উকিল বলছিলেন, ‘‘দুপুরের দিকে মূলত বয়স্ক এবং মাঝবয়সিদের ভিড় বেশি হয়েছে। তার পরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত যত বেড়েছে, ততই তরুণ প্রজন্ম মণ্ডপের দখল নিয়েছে।’’ এই মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনে আসা বেহালার সুলেখা পাত্র বললেন, ‘‘দক্ষিণ শেষ করে প্রতি বার উত্তর কলকাতায় চলে যাই। এ বার আগে ধর্মতলা যাব। সেখানে অনশনস্থলে কিছুটা সময় কাটিয়ে তার পরে ফের প্রতিমা দর্শনে বেরোব।’’
ভিড়ের মধ্যে একই রকম সুর শোনা গেল একডালিয়া এভারগ্রিনের মণ্ডপে আসা কয়েক জনের গলায়। একডালিয়ার পুজোকর্তা স্বপন মহাপাত্র বললেন, ‘‘প্রতি বারই বাহুল্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আর জি কর-কাণ্ডের পরে সেই চেষ্টা এ বার আরও বেশি করে করেছি। দর্শনার্থীদের মুখে সারা দিনে বহু বার আর জি করের কথা শুনেছি। উৎসব নয়, এ বার তাই আমরা শুধুই পুজো করেছি।’’ তবে কি এ বার সুর বদলাচ্ছেন পুজো উদ্যোক্তারা? ত্রিধারা
সম্মিলনীর উদ্যোক্তা দেবাশিস কুমারের দাবি, ‘‘কারও সঙ্গেই কোনও বিরোধ নেই। পুজো রক্ষা করার চেষ্টাটুকু করেছি। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশকে কড়া হতে হয়েছে।’’ উত্তর কলকাতার বাগবাজারের পুজোকর্তা গৌতম নিয়োগী আবার বললেন, ‘‘আর জি কর থেকে আমাদের মণ্ডপ খুব কাছে। পুজো হল, ভিড়ও হল, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন কিছু
একটা খামতি ছিল এ বছর। স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব এ বার আর হল কই?’’
এর মধ্যেই দেখা গেল, নিরঞ্জনের জন্য গঙ্গার দিকে চলেছে শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা। কোনও মতে সেখানে পৌঁছে প্রতিমার কয়েকটি ছবি তুলে এক দর্শনার্থী বললেন, ‘‘আর মণ্ডপে গিয়ে কী হবে! মায়ের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু, উৎসব, আন্দোলন মিলে এই পুজো বহু বছর মনে থাকবে।’’ একই রকম বক্তব্য শোনা গেল ধর্মতলার অনশন
মঞ্চের কাছে লাগানো মাইকেও। এক আন্দোলনকারী মাইক ধরে বললেন, ‘‘অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে এই পুজো কী শক্তি জুগিয়ে গিয়েছিল, তা বহু বছর মনে থাকবে। আমাদের দেবীর বিসর্জন আগেই হয়ে গিয়েছে, লড়াইয়ের এই উৎসব জারি থাকবে।’’