প্রতীকী ছবি।
করোনা অতিমারি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে কতটা অসহায় এ শহরের প্রবীণরা। এই রোগে তাঁদের মধ্যেই মৃত্যুর হার ছিল বেশি। কোথাও অক্সিজেনের অভাবে, কোথাও কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকেই একের পর এক প্রবীণের মৃত্যুর খবর এসেছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, করোনা থেকে সেরে উঠলেও অনেকের দেহেই তার প্রভাব রয়ে গিয়েছে ভাল মাত্রায়। এ দিকে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে যেখানে আগে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন ছিলেন ষাটোর্ধ্ব, এখন সেই সংখ্যা প্রতি ১০০ জনে ১৫ জন। আগামী ২০ বছরের মধ্যে এটাই ২৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে অনুমান। এই পরিস্থিতিতেই বয়স্কদের সার্বিক চিকিৎসার জন্য জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগ চালু হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। যা পূর্ব ভারতের কোনও সরকারি হাসপাতালে এই প্রথম বলে দাবি সেখানকার চিকিৎসকদের।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রের খবর, করোনার প্রথম ঢেউয়ে প্রবীণদের অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি এই বিভাগ চালু করতে উদ্যোগী হয় রাজ্য সরকার। স্বাস্থ্য ভবন এর জন্য বেছে নেয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে। কিন্তু এই বিভাগ চালু হওয়ার আগেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ে। ফলে তখনকার মতো এই বিভাগ খোলা যায়নি। এর পরে করোনার প্রকোপ কমতেই মেডিক্যাল কলেজের এনসিবি ভবনের ছ’তলায় চালু করা হয় জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগ। সেখানেই রয়েছে এই বিভাগের ৩০টি শয্যা। ১৫টি রাখা হয়েছে পুরুষ রোগীদের জন্য, ১৫টি মহিলাদের। এ ছাড়াও চালু হয়েছে বহির্বিভাগ, ফিজ়িক্যাল মেডিসিন এবং ব্যায়ামের বিভাগ। সোম, বুধ এবং শুক্রবার টিকিট করে দেখানো যেতে পারে এখানকার বহির্বিভাগে। এই বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স বা হেলথকেয়ার স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধীনে।
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার, চিকিৎসক সব্যসাচী দাস বলেন, ‘‘আইসিইউ-তে আলাদা করে পাঁচটি শয্যা রাখা হয়েছে জেরিয়াট্রিক বিভাগের জন্য। বয়স্কদের সার্বিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্যই এই উদ্যোগ। বিদেশে বহু দিন থেকেই সচেতন ভাবে এই পরিষেবা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু পূর্ব ভারতে এই বিভাগই প্রথম।’’ ওই বিভাগের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, শৌচাগারে বা অন্য কোথাও হঠাৎ পড়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ওজন কমতে থাকা বা চলাফেরায় সমস্যার মতো এমন বহু বয়সজনিত সমস্যা দেখা যায়, যার সে ভাবে চিকিৎসাই হয় না। একটা সময়ের পর বয়স্করা ধরে নেন, এগুলো নিয়েই চলতে হবে। হাসপাতালে আসেন শুধু চোখ বা হৃদ্রোগের সমস্যার জন্য। কিন্তু এগুলিরও চিকিৎসার প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের দাবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) দেখেছে, বয়স্কদের সুস্থ রাখাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। এই জন্যই ২০২০ থেকে ২০৩০, এই দশককে ‘ডেকেড অব হেলদি এজিং’ বলে স্লোগান দিয়েছে তারা। অর্থাৎ বয়স বাড়ুক, কিন্তু স্বাস্থ্যভাল থাকুক। ভারত সরকারও প্রবীণদের সার্বিক চিকিৎসার লক্ষ্যে চালু করেছে ‘ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর হেলথকেয়ার অব এল্ডারলি’ (এনপিএইচই) প্রোগ্রাম।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান অরুণাংশু তালুকদার জানান, এনপিএইচই প্রোগ্রামে দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে একটি করে রিজিয়োনাল জেরিয়াট্রিক সেন্টার তৈরি হওয়ার কথা। পূর্ব ভারতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগই প্রথম, যেখানে এমডি মেডিসিনের কোর্সও চালু হতে চলেছে। এই বিভাগই এই অঞ্চলের সমস্ত রাজ্যের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের চিকিৎসকদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করবে। তাঁর কথায়, ‘‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কিছু পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনের জন্যও বেশ কিছু রোগ দেখা দেয়। সেটাকে মূলত বয়সজনিত সমস্যা বলে এড়িয়ে না গিয়ে চিকিৎসার জন্যই এই বিভাগ।’’ তিনি জানান, কিছু দিন আগেই এক রোগী এলেন, যিনি বহু হাসপাতালে ঘুরেছেন। কিন্তু পেটের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। দেখা গেল, তাঁর খাদ্যনালিতে সমস্যা হয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে খাদ্যনালির এই সমস্যা বাড়ে। কিন্তু যেটাকেবয়স হলে হয়েই থাকে বলে অনেকেই এড়িয়ে যান। ওই রোগীর ক্ষেত্রেও তেমনই হচ্ছিল, সেটাই এখানে চিকিৎসায় ঠিক হল।