প্রতীকী ছবি।
করোনার প্রকোপ এড়িয়ে কবে স্কুল খুলবে কেউ জানে না। সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা নেই বহু মাস। সকালে কয়েক ঘণ্টার অনলাইন ক্লাসে সুযোগ নেই তাদের সঙ্গে গল্প করার। দেখা হয় না শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও। সুযোগ নেই স্কুলের মাঠে দৌড়ঝাঁপ করারও। এক রকম ঘরবন্দি জীবনই কাটছে পড়ুয়াদের। এই অবস্থায় শিশু কিংবা কিশোর মনকে মানসিক বিষণ্ণতা গ্রাস করছে কি? সম্প্রতি কলকাতার একটি স্কুলের এক দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ার বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে কলকাতার বেশ কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে। তাঁরা উদ্বিগ্ন কচিকাঁচাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।
ওই সব স্কুলের কর্তৃপক্ষেরা জানিয়েছেন, কয়েকটি প্রশ্ন তাঁদেরও ভাবাচ্ছে। তা হল, দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকার জন্য ওই ছাত্রের মধ্যে কোনও মানসিক চাপ জন্মেছিল কি? সে তার বন্ধুবান্ধব বা অভিভাবককে সেই চাপের কথা বলতে পেরেছিল কি? তাঁরা মনে করেন, এই সময়ে সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের।
মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লসের অধিকর্তা তথা শিক্ষাবিদ দেবী কর মনে করেন, অনেক সময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাঁদের মানসিক সমস্যার কথা বড়দের বলতে সঙ্কোচ বোধ করে। তাই তাঁদের স্কুলেই একাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের একটি দল রয়েছে, যারা স্কুলের মেয়েদের যে কোনও অসুবিধার কথা মন দিয়ে শোনে। তার পরে তাদের সমস্যা্র কথা তাদের শিক্ষিকাদের জানায়। দেবী কর বলেন, “আমাদের স্কুলে মনোবিদ রয়েছেন। ছাত্রীদের এই ভাবে মেয়েদের কাছ থেকে মানসিক সমস্যার কথা শোনাটা খুবই কার্যকরী। করোনার মধ্যেও সেটা বন্ধ হয়নি।”
দীর্ঘদিন স্কুলে যেতে না পারায় পড়ুয়াদের মনে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য কৃষ্ণ দামানি। তিনি বলেন, “পড়ুয়াদের মানসিক বিষণ্ণতার কথা অনেক অভিভাবকই বলছেন। আমরা তাঁদের বলছি কোনও ধরনের সমস্যা হলেই অনলাইন ক্লাসের সময়ে ক্লাস টিচারকে জানাতে। প্রয়োজনে মনোবিদও পরামর্শ দিচ্ছেন।”
করোনার পরিবেশে স্বাস্থ্য-বিধিতে শারীরিক স্বাস্থ্যের কথা বারবার আলোচনা হলেও, মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ ক`জন রাখছেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন রামমোহন মিশন স্কুলের অধ্যক্ষ সুজয় বিশ্বাস। তিনি জানান, তাঁরা শিক্ষকদের জানিয়েছেন অনলাইন ক্লাসে পড়ুয়াদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। কোনও ছাত্র যদি ক্লাসে লাজুক হয়ে থাকে কিংবা কথা বলতে না চেয়ে বারবার অফলাইনে চলে যায়, সে ক্ষেত্রে তাকে অভিভাবকের সঙ্গে এমনকি মনোবিদের সঙ্গেও কথা বলতে শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়ার কথা জানান সুজয়বাবু। তিনি বলেন, “পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি বেশির ভাগই স্কুলে আসতে উৎসাহী। করোনার মধ্যে বিশেষ করে ছোট ছোট পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন আছে, সে বিষয়েও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।”
ন্যাশনাল ইংলিশ হাইস্কুলের অধ্যক্ষা মৌসুমী সাহা জানান, তাঁদের স্কুলে এখনও নিয়মিত কাউন্সেলিং চলছে। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে না আসায় অনেক পড়ুয়া কাজে মনঃসংযোগ হারিয়ে ফেলছে। আমাদের স্কুলের ফেসবুক পেজে তাদের জন্য কাজের উৎসাহ জিইয়ে রাখার নানা ধরনের উক্তি রোজ লেখা হচ্ছে।”
নিউ টাউন স্কুলের অধিকর্তা সুনীল আগরওয়াল জানান, তাঁদের স্কুলের ওয়েবসাইট থেকেই পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা মনোবিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারেন। উত্তর কলকাতার একটি স্কুলের পড়ুয়াদের নানা রকম মানসিক সমস্যার কথা্ দীর্ঘদিন ধরে শুনছেন মনোবিদ সুগত ঘোষ। তিনি বলেন, “পড়ুয়াদের মধ্যে নানা রকম মানসিক সমস্যা আগেও ছিল। করোনা-কালে তা আরও প্রকট হয়েছে। তাদের বহু মানসিক সমস্যা আগে স্কুলই সামলেছে। এখন স্কুলে তারা যেতে পারছে না। পড়ুয়াদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনা এখন অভিভাবকদের আরও বেশি করে দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”