উৎসবের মুখ ভার। বিষণ্ণ মুখ কলকাতার খুদে সান্তার। ছবি: অনির্বাণ সাহা।
আলুর পরোটা, পালক পনির আর আচার সহযোগে দুপুরের খাওয়া সারছেন বছর চল্লিশের বস্ত্র ব্যবসায়ী। বেলা আড়াইটে। দোকান বিলকুল ফাঁকা, কর্মচারীরাও সম্ভবত খাওয়া-দাওয়া সারতেই বেরিয়েছেন।
ব্যবসার হাল-হকিকত কেমন? বড়দিনের বাজারে এ রকম ফাঁকা দুপুর? কিছু একটা বলতে গিয়েও ঢোঁক গিলে নিলেন ব্যবসায়ী। সম্ভবত সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে চান না। সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘ভালই চলছে।’’ নগদের সমস্যা নেই তো? ‘‘না, কোনও সমস্যা নেই। সবাই কার্ডে দাম দিচ্ছে।’’ ই-ওয়ালেটের ব্যবস্থা করেছেন? অবাঙালি ব্যবসায়ী এ বার একটু অস্থির হয়ে উঠলেন, বেশি কথা বলতে যেন দ্বিধা। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব করে নিয়েছি। সাকসেস, সাকসেস।’’
হগ মার্কেটে বহু বছরের জামাকাপড়ের ব্যবসা সাহানি পরিবারের। একটা দোকান এখনও সামলাচ্ছেন বছর সত্তরের রমেশ সাহানি। অন্যটার দেখভাল করছেন রমেশবাবুর বছর চল্লিশের ছেলে। নোট সঙ্কট নিয়ে ছেলে মুখ খুললেন না ঠিকই, কিন্তু বাবা রহস্যটা ভেঙে দিলেন। বড়দিনের বাজারে দুপুর আড়াইটের সময় হগ মার্কেটের মতো জায়গায় দোকান ভোঁ-ভাঁ ফাঁকা আর মালিক পরম নিরুপদ্রবে মধ্যাহ্নভোজ সারছেন, এ ছবি যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, তা বলাই বাহুল্য। প্রবীণ ব্যবসায়ী অভ্রান্ত বুঝে নিয়েছেন, ছেলের জবাবগুলো বেশ গোলমেলে হয়েছে। বললেন, ‘‘অসুবিধা কি হচ্ছে না? খুব হচ্ছে। বাজারে নগদ নেই, খদ্দেরও নেই। সবাই ২০০০ টাকার নোট নিয়ে হাজির হচ্ছে। কত ভাঙাব? আর ই-ওয়ালেট এখনও সবাই ব্যবহার করতে পারেন না। আমরাই পারি না। ব্যাঙ্ক থেকে বা সরকার থেকে কেউ এসে কখনও শেখায়ওনি, এ সব কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়। ট্রেনিং ছাড়া কি এ সব হয় নাকি?’’ তা হলে ছেলে মুখ খুললেন না কেন? রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, ইঙ্গিত দিলেন রমেশ সাহানি।
দেখুন ভিডিও:
কেক, জাঙ্ক জুয়েলারি, জুতো, খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিস— সব দোকানেই কম-বেশি একই ছবি। বছর ষোলোর আদনান আনিস দোকানে বসে ভাঙা বাংলায় বলছে, ‘‘ইন্ডিয়া এখন ক্যাশলেস হতে পারবে না।’’ আর সামনের ফুটপাথে সান্তা-টুপির গোছা কাঁধে ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা বছর পনেরোর আরিফ হিন্দিতে জানাল, খুচরোর আকালে টুপি বেচতে পারছে না সে।
হাঁকডাকই সার।
এ বারের বড়দিনে সান্তাক্লজ যেন বেশ কৃপণ এ ভাবেই। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম এই বড়দিন। বর্ষশেষের দেদার উচ্ছ্বাস, আর নতুন বছরটার জন্য একরাশ অক্সিজেন শুষে নেওয়া, বড়দিন এখন বাঙালির কাছে অনেকটা এ রকমই। হুজুগে বাঙালিকে কেক, হুল্লোড় আর উপহারের ফোয়ারা জুগিয়ে পোয়াবারো ব্যবসায়ীদেরও। ফি বছর এই ভাবেই ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়দের জন্যই উপহারের ডালি সাজিয়ে হাজির হন সান্তাক্লজ। কিন্তু নোট সঙ্কটের ধাক্কায় সান্তার ঝোলাতেও যেন এ বার উপহারের আকাল।
সুদূর দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় শপিং করতে এসেছেন কেউ। ফি বছরই আসেন। কিন্তু যতটা সুবিধা হবে ভেবেছিলেন, ততটা মোটেই হচ্ছে না। বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম দুর্গাপুরে যতটা সমস্যা, ততটা এখানে হবে না। কিন্তু এখানেও দু’হাজারের নোট ভাঙাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। পকেট থেকে ১০০ টাকার নোট বার করতেও ভাবতে হচ্ছে। সবটা খুচরো বেরিয়ে গেলে খুব মুশকিল। ৫০০ টাকার তো দেখাই পাচ্ছি না।’’ নিউ মার্কেট, হগ মার্কেট বা এসপ্ল্যানেড চত্বরে যাঁরা ভিড় জমাচ্ছেন, তাঁদের সবার অবস্থাই কি এই রকম? এক তরুণ মুচকি হেসে বললেন, ‘‘লোক ঘুরছে বেশি, কিনছে কম।’’
নাহুম’সের সামনে লাইন অনেক কম এ বার।
নাহুম’সের কেক নিতে লাইন অবশ্য এ বারও রয়েছে। যে কোনও এটিএম-এর চেয়ে বড় লাইন। ইহুদি কেকশপ কি খুচরোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছে? ম্যানেজার জেসিকা ব্যাপটিস্ট জানালেন, তেমন কিছুই নয়। খুচরোর আকাল তাঁদেরও যথেষ্টই। যাঁরা খুচরো দিতে পারছেন, তাঁরা নির্বিঘ্নে কাঙ্খিত বস্তুটি পাচ্ছেন। আর যাঁদের কাছে শুধু গোলাপি রঙের নোট, তাঁদের হয় খুচরো নিয়ে আসতে বলা হচ্ছে, না হলে একটু বেশি কেনাকাটার অনুরোধ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ক্রিসমাস আর নস্টালজিয়ায় ভরা বো ব্যারাকস
নাহুম’সের লাইন বেয়ে কেকের দিকে এগোতে থাকা এক তরুণ আবার নোট সঙ্কটের ‘ইতিবাচক’ একটা দিক তুলে ধরলেন। বললেন, ‘‘অন্য বার এর তিন গুণ লম্বা লাইন থাকে। এ বার অনেক কম। খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছি। সুবিধাই হচ্ছে।’’ কথা শেষে অবশ্য একটা বাঁকা হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন, কথায় শ্লেষ ছিল।
ভিডিও: অজয়শঙ্কর রায়।