গ্রেফতারির পরে তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র
ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘‘আমি বিধাননগরের অনুব্রত। আমাকে বিপদে ফেলা যাবে না।’’ মঙ্গলবার সকালে গ্রেফতার হয়ে গেলেন সেই ‘অনুব্রত’ই— বিধাননগরের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। মঙ্গলবার আদালতে তোলা হলে বিচারক তাঁকে ১৪ দিন জেল হেফাজতে রাখতে বলেন। পুলিশ অনিন্দ্যকে নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন করেনি। এ দিন তাই দমদম জেলে পাঠানো হয় তাঁকে।
বলপ্রয়োগ, তোলা চেয়ে হুমকি, প্রাণে মারার হুমকি, ষড়যন্ত্র-সহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে। সরকার পক্ষের আইনজীবী সাবির আলি অভিযোগ করেন, ওই কাউন্সিলরের হুমকির জেরে অভিযোগকারীর ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে।
এ দিন আদালতের এজলাসে বসে ভাবলেশহীন মুখে সেই অভিযোগ সংক্রান্ত সওয়াল-জবাব শুনে যাচ্ছিলেন অনিন্দ্য। যে ভাবে আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে একের পর এক যুক্তি খাড়া করছিলেন, তাতে এক সময়ে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছে তাঁর চোখেমুখে। কিন্তু বিচারক সুব্রত ঘোষের নির্দেশ শুনে নিশ্চুপ হয়ে যান তিনি। বেরোনোর মুখে শুধু বলেন, ‘‘আমি দলের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করব না।’’
অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে তোলা আদায়ের হুমকির অভিযোগ এনেছেন ব্যবসায়ী সন্তোষ লোধ। অনিন্দ্যর ওয়ার্ডে তাঁর একটি বাড়ি রয়েছে। সন্তোষবাবু নিজে বিধাননগরেরই অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। অতীতে বড়বাজার যুব কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তখন রাজ্যের যুব কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্তমানে যিনি উত্তর কলকাতার সাংসদ এবং লোকসভায় তৃণমূল দলনেতা। সেই পুরনো সম্পর্কের সুবাদেই সুদীপবাবুকে চিঠি লেখেন সন্তোষবাবু।
ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ ছিল, গত ২০ মার্চ তাঁর বিডি ৩৪৭ নম্বর বাড়ির সংস্কারের কাজ হওয়ার কথা ছিল। সে জন্য বাড়ির সামনে বালি, পাথর জড়ো করা হচ্ছিল। অভিযোগ, সে সময়ে অনিন্দ্যর নেতৃত্বে দলবল গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। ইমারতি সামগ্রী বাইরে ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি সন্তোষবাবুকে হুমকিও দেওয়া হয়। বলা হয়, ১২ লক্ষ টাকা না দিলে কাজ করতে দেওয়া হবে না। সন্তোষবাবুর ওই চিঠি বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তের কাছে পাঠিয়ে দেন সাংসদ সুদীপবাবু।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথার ফাঁকেও সন্তোষবাবুর প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। জানা গিয়েছে, তখনই মমতা সুদীপকে জানান, অনিন্দ্যকে আর ছেড়ে কথা বলা হবে না। খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
পুলিশ সূত্রের খবর, সন্তোষের অভিযোগপত্র সুদীপ ও সব্যসাচীর হাত ঘুরে পৌঁছয় বিধানগরের পুর-কমিশনার অলোকেশপ্রসাদ রায়ের কাছে। সেই চিঠি তিনি পাঠিয়ে দেন বিধাননগর উত্তর থানায়। ওই চিঠিটিকেই অভিযোগ হিসেবে গণ্য করতে অনুরোধ করেন তিনি। তার ভিত্তিতেই মামলা রুজু করে গ্রেফতার করা হয় অনিন্দ্যকে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতারের আগে অনিন্দ্যকে কাউন্সিলর পদ থেকে ইস্তফা দিতেও বলা হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ দিন সকালে সন্তোষবাবুর মেয়ে সুচরিতা বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংহের কাছে অনিন্দ্যর নামে আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সূত্রের খবর, সন্তোষ লোধ ছাড়াও তাঁর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্য এক বাসিন্দার কাছ থেকেও সম্প্রতি তোলা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে। সেই ব্যক্তি বাংলাদেশের কোনও মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে সূত্রের খবর। এই তোলা চাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সম্প্রতি মৌখিক ভাবে রাজ্য সরকারকে জানানো হয়। সে কথা জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতেও যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন তিনি।
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘তৃণমূল জমানায় বহু অনিন্দ্য রয়েছে। তোলাবাজের গ্রেফতারেও মুখ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হল!’’ বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘রাজ্যবাসী হিসেবে মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। দু’দিন পরে হয়তো এই কাউন্সিলর জামিনে খালাস পেয়ে যাবেন। না হলে ভোটের আগে ছাড়া পাবেন! তৃণমূলের রাজত্বে তো সেটাই হচ্ছে।’’
তৃণমূলের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, দলের ভিতরে এই ধরনের কাজকর্ম তিনি বরদাস্ত করবেন না। কারও সম্পর্কে এমন অভিযোগ উঠলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
২০১০ সালে বিধাননগর পুরসভার কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন অনিন্দ্য। তার আগে তিনি সাংবাদিকতা করতেন। তখন অনিন্দ্য বিধাননগরে একটি পাক্ষিক সংবাদপত্র চালাতেন। সেই সময়ে বিধাননগরে বেআইনি বাড়ি হস্তান্তরের ঘটনায় দু’পক্ষের থেকে টাকা তোলার অভিযোগ ওঠে অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, যে অনিন্দ্য বরাবরই তোলাবাজিতে সিদ্ধহস্ত, তৃণমূলের কাউন্সিলর হওয়ার পরে তাঁর সেই অভ্যাস আরও লাগামছাড়া হয়ে যায়। সেই সময়ে তাঁর মাথার উপরে রাজ্যের এক মন্ত্রীর প্রশ্রয়ের হাত ছিল বলেও জানা গিয়েছে। সেই ‘আশীর্বাদ’-এর জোরেই ২০১৫ সালে আবার কাউন্সিলর পদের টিকিট পান তিনি। অভিযোগ, সেই নির্বাচনে তাঁর ওয়ার্ডেই বহিরাগতদের দাপাদাপি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এবি ব্লকের বাসিন্দা প্রীতিকুমার সেনকে রাস্তায় ফেলে মারধরের অভিযোগও উঠেছিল অনিন্দ্যর দলবলের বিরুদ্ধে।
অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত দু’টি— এক, বেলাগাম টাকা তোলা। দুই, দুর্ব্যবহার। শুধু বাড়ি নয়, তাঁর ওয়ার্ড এলাকার প্রতিটি কোনা থেকে ওই কাউন্সিলর টাকা তুলতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁর ওয়ার্ড এলাকায় একটি বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, এক ব্যক্তি এবি-এসি মার্কেটে একটি সেলুন কিনতে যান। অভিযোগ, এর জন্য তাঁকে ৭ লক্ষ টাকা দিতে হবে বলে দাবি জানান অনিন্দ্য। জানা গিয়েছে, অনিন্দ্যর ‘দাদাগিরি’তে অতিষ্ঠ বিসি ব্লকের এক প্রবীণ নাগরিক বলেন, ‘‘চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় আমার আত্মীয়কে ঘরে আটকে রাখা হয়। নিজের বাড়িতে একটি নির্মাণকাজ করতে গিয়ে চরম বিপদে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।’’ শুধু তোলাবাজিতেই শেষ নয়, পুরসভার জমিতে বেআইনি ভাবে ঘর বানিয়ে দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে।
স্বাভাবিক ভাবেই এ দিন তাঁর গ্রেফতারির খবরে কিছুটা স্বস্তিতে এলাকার বাসিন্দারা।
দলের এক কাউন্সিলর গ্রেফতার হওয়ার পরে পুর-নিগম কি পদক্ষেপ করবে? মেয়র সব্যসাচী দত্ত এ দিন বলেন, ‘‘দল যে ভাবে নির্দেশ দেবে, সেই মতোই পদক্ষেপ করা হবে।’’