ডানলপের গলি, তস্য গলি। গাড়ি নিয়ে ঢোকা বেশ কঠিন।
১৮ নম্বর কার্তিকচন্দ্র নিয়োগী লেনে হলুদ রঙের ফ্ল্যাটবাড়ি। তারই চারতলায় একটি ফ্ল্যাটে সপরিবার রোহিত শর্মার বাস। আবার সেটাই ‘স্কাইওয়ার্ড অ্যাভিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সরকারি ঠিকানা। অন্ডাল থেকে বাগডোগরা, বাগডোগরা থেকে কোচবিহার, কোচবিহার থেকে কলকাতা আর কলকাতা থেকে ফের অন্ডাল— মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের উড়ান-পথে বিমান চালানোর বরাত পেয়েছে যে সংস্থা। রোহিত ওই সংস্থার ডিরেক্টর।
মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার ভার পড়েছে বেঙ্গল অ্যারোট্রপলিস প্রাইভেট লিমিটেড (বিএপিএল)-এর উপরে। অন্ডালের বেসরকারি বিমানবন্দরের মালিক তারা। তাদের দিয়ে টেন্ডার করিয়েছে রাজ্য সরকার। টেন্ডারে বিএপিএল জানিয়েছে, অন্ডাল থেকে বাগডোগরা-কোচবিহার-কলকাতা ঘুরে বিমান চালানোর জন্য ভর্তুকি মিলবে। কেন? বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই রুটে বিমান চালানোর যা খরচ, তার সামান্য অংশই আসবে টিকিট বিক্রি করে।
রাজ্য সরকারও তা বিলক্ষণ তা জানে। রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খরচের বাকি টাকা আধাআধি মেটাবে রাজ্য সরকার এবং বিএপিএল। এর অর্থ, প্রতি দিন উড়ান চালাতে যদি ১০০ টাকা খরচ হয় এবং টিকিট বিক্রি থেকে ৩০ টাকা পাওয়া যায়, তা হলে রাজ্য সরকার এবং বিএপিএল ৩৫ টাকা করে ভর্তুকি দেবে। দরপত্র দেওয়া সংস্থাগুলির মধ্যে স্কাইওয়ার্ড-কেই বেছে নেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনা মেনে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে মালদহ ও বালুরঘাট বিমানবন্দরও।
রোহিত জানান, তাঁর সংস্থাই ১৪ আসনের বিমান চালাবে। মাত্র চার মাস আগে এই সংস্থাটি তৈরি করেছেন ৩১ বছরের ওই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তাঁর সংস্থার কি বিমান রয়েছে? রোহিতের উত্তর, ‘‘না’’। তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের উড়ান-পথে তাঁর সংস্থা বিমান চালাবে কী করে? রোহিতের জবাব, ‘‘ওলা-উবের যে ট্যাক্সি চালাচ্ছে, তা তো তাদের কেনা নয়! আমাদেরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সেটা কী, এখনই খোলসা করছি না।’’ মোবাইল ফোনের নম্বর দিতে কিংবা ছবি তোলাতেও আপত্তি জানান নির্দ্বিধায়।
এ দেশের আকাশে বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ করে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)। তাদের নিয়ম অনুযায়ী, কোনও সংস্থা বিমান ভাড়া করে চালাতেই পারে। কিন্তু যে সংস্থা বিমান চালাবে, তাদের ডিজিসিএ-র কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। যে সব সংস্থা নিয়মিত বিমান চালায়, তাদের শিডিউলড এয়ারলাইন্স বলা হয়। তার বাইরেও যারা যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করে, তারা নন-শিডিউলড বিমানসংস্থার তালিকায় পড়ে। সেই অর্থে, স্কাউওয়ার্ড যদি বিমান চালায়, তা হলে তাদেরও নন-শিডিউলড তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ডিজিসিএ-র ওয়েবসাইটে নন-শিডিউলড বিমানসংস্থার তালিকায় নাম নেই এই সংস্থার।
তাঁর সংস্থার ডিজিসিএ-র লাইসেন্স রয়েছে কি না, তা-ও জানাতে রাজি নন রোহিত। বলেন, ‘‘এ সবই গোপন তথ্য। আপনাকে বলা যাবে না।’’ ডিজিসিএ-র তালিকায় স্কাইওয়ার্ড-এর নাম নেই। তা হলে তারা বিমান চালাবে কী করে? জবাব দেননি সংস্থার প্রধান। ডিজিসিএ-র এক কর্তা বলেন, ‘‘কোনও সংস্থাকে বিমান চালানোর বরাত দেওয়ার আগে অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত, ডিজিসিএ-র লাইসেন্স তাদের রয়েছে কি না।’’
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই রুটে উড়ান চালানোর জন্য ‘পার এয়ার’ নামে এক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে স্কাইওয়ার্ড। ‘ডেকান চার্টার্ড’ নামে এক সংস্থার সঙ্গেও যোগসূত্র গড়ে তুলছে তারা। এই দুই সংস্থার কোনও একটি তাদের বিমান দেবে। পার এয়ারের যাত্রী বিমান চালানোর লাইসেন্স রয়েছে। সেই লাইসেন্সও ব্যবহার করা হতে পারে। তেমনই বন্দোবস্ত হলে স্কাইওয়ার্ড-এর তো কিছুই করার থাকে না! রোহিত শুধু বলেন, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রকল্পে নেমেছি। আমার পরিবহণের ব্যবসা রয়েছে। মনে হয়েছে, এই রুটে বিমান চালালে লাভ হবে।’’
ইন্টারনেটে স্কাইওয়ার্ড (skyword, রোহিতের সংস্থা) লিখে সার্চ করলে আমেরিকার নামকরা স্কাইওয়ার্ড (skyward)-এর খোঁজখবর ভেসে উঠছে। এটা কেন? রোহিত বলেন, ‘‘এখনও ওয়েবে ঢুকতে পারিনি আমরা।’’
কলকাতায় পার এয়ার-এর প্রতিনিধি এস মুরলিকৃষ্ণন বলেন, ‘‘এ নিয়ে আমার কিছু বলার এক্তিয়ার নেই। যা বলার বিএপিএল বলবে।’’ বিএপিএল-ও চুপ। ডেকান চার্টার্ড আদতে ক্যাপ্টেন গোপীনাথের সংস্থা। যাঁকে ভারতীয় বিমান পরিবহণে সস্তার উড়ানের পথ প্রদর্শক বলা হয়। তাঁর সংস্থার সিইও সঞ্জয় সায়গল বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানি না আমরা।’’
বিমান পরিবহণ বিশেষজ্ঞদের মতে, মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের রুটে ১৪ আসনের একটি বিমান চালাতে বিপুল লোকসান হবে। যুক্তি দিয়ে তাঁরা জানান, অন্ডাল থেকে রওনা হয়ে অন্ডালে ফিরতে চার-চারটি বিমানবন্দরে ওঠানামা করতেই অনেকটা জ্বালানি পুড়বে।
তাতে অবশ্য রাজ্য সরকারের তেমন পরোয়া নেই।