শহরের স্কুলেও শৌচাগার-সঙ্কট, বলছে রিপোর্ট

কোনও স্কুলে শৌচাগার রয়েছে, কিন্তু কল নেই। কাজ চালাতে হয় বালতির জলে। কোথাও আবার জল থাকলেও হাত ধোয়ার সাবান নেই। কোথাও বা শৌচাগার ও প্রস্রাবাগার রয়েছে একসঙ্গে।

Advertisement

সুপ্রিয় তরফদার

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২০
Share:

এমনই হাল বহু স্কুলে। — নিজস্ব চিত্র

কোনও স্কুলে শৌচাগার রয়েছে, কিন্তু কল নেই। কাজ চালাতে হয় বালতির জলে। কোথাও আবার জল থাকলেও হাত ধোয়ার সাবান নেই। কোথাও বা শৌচাগার ও প্রস্রাবাগার রয়েছে একসঙ্গে। আর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পড়ুয়াদের জন্য তো ৯২ শতাংশ স্কুলে কোনও শৌচাগার নেই। এই চিত্র কোনও পিছিয়ে পড়া গ্রামের নয়। খাস কলকাতারই সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও সরকার পোষিত প্রাথমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের চিত্র ফুটে উঠছে সর্বশিক্ষা মিশন এবং রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযানের রিপোর্টে।

Advertisement

সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রে খবর, ২০১৫-’১৬ শিক্ষাবর্ষে কলকাতার ১৫১০টি প্রাথমিক, ৬২৯টি উচ্চপ্রাথমিক এবং ২১৩৯টি মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, মিড ডে মিল বণ্টন থেকে শুরু করে স্কুল ভবন ও শৌচাগারের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কার্যত ছত্রে ছত্রে আপস করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ১৫১০টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৫৫৪টি স্কুলের শৌচাগারে কলকাতা পুরসভার জলই পৌঁছয়নি। উচ্চপ্রাথমিকে ও মাধ্যমিকের ২৪৭টি স্কুলও বঞ্চিত পুরসভার জল থেকে। ফলে সেখানে রয়ে যাচ্ছে সংক্রমণের আশঙ্কা। স্কুলের বাইরে বা ভিতরের কল থেকে বালতি করে জল নিয়ে যেতে হয় শৌচাগারে। কলকাতার মোট স্কুলের প্রায় ২৮ শতাংশ স্কুলের শৌচাগারেরই এই অবস্থা বলে রিপোর্টে প্রকাশ হয়েছে।

এতেই শেষ নয়। বালতিতে কোনও ভাবে শৌচাগারে জল নিয়ে গেলেও হাত ধোয়ার সাবানের ব্যবস্থাও নেই। সেই তালিকায় রয়েছে ৫৬৭টি স্কুল। যে কারণে বহু পড়ুয়াই ওই সব শৌচাগার ব্যবহার করতে চায় না। একই ঘরে শৌচাগার এবং প্রস্রাবাগার রয়েছে ৫৯৬টি স্কুলে। এই তিনটি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই খাস শহরের স্কুলগুলিতে।

Advertisement

ওই সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা অবশ্য এই সমস্যা নিয়ে যথেষ্টই বিরক্ত। কালিকাপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নাদিয়াল হাই স্কুলে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কোথাও বছর চারেক আগে জল পাওয়া গেলেও এখন তা অমিল। নাদিয়ালের একাধিক স্কুলে স্থানীয়দের উদ্যোগেই পড়ুয়াদের ভাগ্যে জুটেছে জল। কোথাও পুরসভা স্কুলের বাইরে জলের লাইন দিলেও‌ শৌচাগার পর্যন্ত তা নিয়ে যাওয়ার অর্থ জোগাতে পারছেন না স্কুল-কর্তৃপক্ষ। একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘‘সম্প্রতি সর্বশিক্ষা মিশন ও সংসদকেও সমস্যা সমাধানের আর্জি জানানো হয়েছে।’’ আলিপুর সার্কেলের একাধিক স্কুলের অবস্থাও খুব করুণ বলে জানান সর্বশিক্ষা মিশনের এক কর্তা।

এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে প়ড়া বা সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন প্রস্রাবাগার মেয়েদের মূত্রঘটিত সংক্রমণের অন্যতম কারণ। সংক্রমণ এড়াতে এই ধরনের প্রস্রাবাগারে মেয়েরা যেতেই চায় না।’’ তিনি জানান, দিনভর শৌচাগার ব্যবহার না করাও ক্ষতিকর শরীরের জন্য। এর ফলে কিডনি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার থেকে পাকস্থলীতেও সংক্রমণ ঘটে।’’

সর্বশিক্ষা মিশনের এক কর্তা জানান, শিক্ষার অধিকার আইনে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পড়ুয়াদের জন্য স্কুলে পৃথক শৌচাগার করার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে প্রকাশ হয়েছে, প্রাথমিকের ১৫১০টি স্কুলের মধ্যে ১৪১৭টিতেই পৃথক শৌচাগার নেই। উঠে এসেছে কম্পিউটার শিক্ষার দৈন্যদশাও। এখন যে কোনও কাজেই কম্পিউটার অপরিহার্য। কিন্তু ১৫১০টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ১৩৩৯টিতেই কম্পিউটার নেই। শহরের মোট ১৫২টি স্কুলে মিড-ডে মিল চালু করা যায়নি। মোট ১৫৯১টি স্কুলের মিড-ডে মিল স্কুল চত্বরে তৈরি করা যায় না। ‘‘কারণ স্কুল চত্বরে খাবার তৈরির জায়গাই নেই,’’ মন্তব্য সর্বশিক্ষা মিশনের এক কর্তার। ১৩২৬টি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা নেই। স্কুলে ঘেরা পাঁচিলের অভাব রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, পরিকাঠামো থেকে শৌচাগারের পরিস্থিতি, সমস্ত ক্ষেত্রেই বেহাল দশা প্রকট হয়ে উঠেছে।

সর্বশিক্ষা মিশনের চেয়ারম্যান (কলকাতা) কার্তিককুমার মান্না বলেন, ‘‘জলের সমস্যা সমাধানের জন্য কলকাতা পুরসভার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। প্রতিটি শৌচালয়ে যেন হাত ধোয়ার সাবানের ব্যবস্থা করা যায়, সে কারণে ২০১৬-’১৭ বর্ষে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বহু স্কুল নিয়েও গিয়েছে। এই সমস্যা মিটে যাবে।’’ যেটুকু সমস্যা রয়ে গিয়েছে, তা দ্রুত মিটিয়ে ফেলার জন্য ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানান দফতরের এক কর্তাও। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য পৃথক কোনও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই বিষয়ে নীরব সর্বশিক্ষা মিশন। বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সহ-সধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন না হওয়ার জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন বলে যা চালানো হচ্ছে, তা আসলে ‘কসমেটিক’ উন্নয়ন। শুধু জুতো দিয়ে শিক্ষার যে উন্নয়ন করা যায় না, এটা তারই প্রমাণ।’’

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কলকাতার সব স্কুলেই শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছে। তবুও ওই সমীক্ষার সমস্ত তথ্য খতিয়ে দেখা হবে। যদি গাফিলতি দেখা যায়, তা হলে আধিকারীকদের তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement