হাবিব তনভির (ছবি) ছবি: সুধন্বা দেশপাণ্ডে
কেরিয়ারের মধ্যগগনে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাবিব তনভির (ছবি) আবারও ঝুঁকি নিলেন। শহর হোক কি গ্রাম, মঞ্চে তত দিনে যে সব লোককাহিনির নাট্য-রূপান্তর ঘটিয়ে তিনি নজর কেড়েছিলেন, তাদের উপস্থাপনার ভাষা ছিল হিন্দি বা উর্দু। এ বার তাঁর জন্মমাটি ছত্তীসগঢ়ের নানা উপভাষাকে মঞ্চে নিয়ে এলেন, ফর্ম ও কন্টেন্টকে অনায়াসে মিলিয়ে নাটককে নিয়ে এলেন মাটির আরও কাছে। অবশ্য তাঁর নাটক ও জীবনদর্শন নিয়ে যাঁরা অবহিত তাঁরা জানেন, তনভির এমনই। ১৯৫৪-তে তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় নাটক আগরা বাজ়ার-এ প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একেবারে আনকোরা অভিনেতাদের করলেন রঙ্গমঞ্চের কুশীলব।
শুরুতে ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো বোম্বে-র প্রযোজক। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য হন, যুক্ত হন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গেও। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নাটক নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে আর পিছন ফিরে তাকালেন না। সে বার ইউরোপ সফরে পাশ্চাত্যের নাট্যধারা চাক্ষুষ করলেন, বিশেষত ব্রেশটের নাটক এতটাই প্রভাব ফেলল যে, দেশে ফিরে থিয়েটারেই পুরোপুরি মন দেবেন স্থির করলেন। ১৯৫৯ সালে শুরু করলেন নিজের দল ‘নয়া থিয়েটার’। ছত্তীসগঢ়ের লোকসংস্কৃতি, নাচ নিয়ে এলেন মঞ্চে।
একে একে মিট্টি কি গাড়ি, পোঙ্গা পণ্ডিত, হিরমা কি অমর কহানি, গাঁও কে নাঁও সসুরাল, মোর নাঁও দামাদ-এর মতো নাটক, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও উপমহাদেশের থিয়েটারের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে পরিচিতি। শিশির ভাদুড়ি, উৎপল দত্তের মতোই একই সঙ্গে নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক-সুরকার হাবিব তনভির, চরণদাস চোর-এ হাস্যরসের ছলে সমাজের অধঃপতনের আয়নায় মুখ দেখতে বাধ্য করলেন আমাদের। তাঁর কলম, কবিতা, নাটক অবিরত নিশানা করেছে অসহিষ্ণুতা, বর্ণভেদ, ভণ্ডামি, মৌলবাদকে। শাসকের চক্ষুশূলও হয়েছেন বার বার। সফদর হাশমির সঙ্গে এখানে তিনি একাসনে। কাজও করেছেন এক সঙ্গে, মুন্সী প্রেমচন্দের গল্প অবলম্বনে মোটেরাম কা সত্যাগ্রহ।
আরও এক বার তাঁর জীবনকৃতির রসাস্বাদনের সুযোগ পাচ্ছে শহর। হাবিব তনভিরের জন্মশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) আয়োজন করেছে তিন দিন ব্যাপী উৎসব ‘দেখ রহে হ্যায় নয়ন’, কিউরেট করছেন এম কে রায়না আঞ্জুম কাটিয়াল ও তৌসিফ রহমান। থাকছে হাবিবের নাটক ও তার চলচ্চিত্র-রূপ; প্রদর্শনী, বই প্রকাশ, গান, ছবি, আলোচনা। নাট্যোৎসাহীদের জন্য নাসিরুদ্দিন শাহ ও রঘুবীর যাদবের মাস্টারক্লাস; রত্না পাঠক শাহের একক পরিবেশনা দস্তান-এ-অশোক-ও-আকবর, হাবিব-কন্যা নাগিন তনভিরের গলায় নাটকের গান। বেরোবে দু’টি বই, সফদর হাশমি: টুয়ার্ডস থিয়েটার ফর আ ডেমোক্রেসি এবং হাবিব তনভির অ্যান্ড হিজ় লেগ্যাসি ইন থিয়েটার। আলোচনায় সুধীর মিশ্র ব্রহ্ম প্রকাশ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভাস চক্রবর্তী সুমন মুখোপাধ্যায় অঞ্জুম কাটিয়াল প্রমুখ। ‘হাবিব আনপ্লাগড’ পর্বে লোকগানে রঘুবীর যাদব-শুভদীপ গুহ; দানিশ হুসেনের নির্দেশনায় হাবিবনামা। এই সবই ৩০ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
তিনশো বছরে
পিতার মৃত্যুর পর তাঁর ‘উত্তরাধিকার’, শ’তিনেক টাকার ঋণ শোধ করে আগরা ছেড়ে দিল্লি আসেন মীর তাকি মীর। রসিক সমাজে কবি হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি উর্দুকে মোগল দরবারের ঘেরাটোপ থেকে বার করে বসিয়েছিলেন জামা মসজিদের সিঁড়িতে। অগ্রজ কবির প্রতি শ্রদ্ধা ছিল মির্জা গালিবেরও। প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, বিশুদ্ধ এই দিল্লিওয়ালা নিজের কাজের মধ্যে ধরে রেখেছিলেন যুগসন্ধির এক টালমাটাল সময়। কবির জন্মের তিনশো বছর (জন্ম ১৭২৩) পালনের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করল কলকাতা; গুরুদাস কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ ও রাজ্য উর্দু অ্যাকাডেমির উদ্যোগে গত ২৮-৩০ অগস্ট হয়ে গেল জাতীয় স্তরের আলোচনা। ভারত-ধারণা ও ভারতীয় সাহিত্যের চুম্বকে আলোচিত হল কবিকৃতি। ছিলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি আনিসুর রহমান নাদিমুল হক-সহ বিশিষ্টজন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
দেশ-বন্দনা
স্বাধীনতা আর সঙ্গীতসাধনা যে একত্রে মিশতে পারে, তা-ই করে দেখাল সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (আইটিসি-এসআরএ)। প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি মগ্ন গুরু-শিষ্য পরম্পরায় হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাধনা ও চর্চায়, ২০২৭-এ উদ্যাপিত হবে সুবর্ণজয়ন্তী। শিল্পীরা তো দেশবিযুক্ত নন, ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে গুরু-শিষ্যেরা মিলিত হয়েছিলেন নতুন এক সঙ্গীত সৃষ্টিতে, যোগ দিয়েছিলেন অন্য বিশিষ্ট শিল্পীরাও। তারই ফসল দেশ রাগে বাঁধা কম্পোজ়িশন ও মিউজ়িক ভিডিয়ো ‘দেশ: এক রাগ’। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের অনুষঙ্গে সেখানে ধরা মার্গসঙ্গীতের নির্যাস। ইউটিউবে শোনা যাচ্ছে কম্পোজ়িশনটি।
স্মরণে, সম্মানে
১৯৮৮ সালে যাত্রাশুরু ‘অনীক’ নাট্যদলের। প্রতিষ্ঠাতা অমলেশ চক্রবর্তী চেয়েছিলেন, সৃজন, সমন্বয় ও দায়বদ্ধতা হবে দলের মানসাঙ্ক। নিজেদের প্রযোজনা, সঙ্গে নানা নাট্যদলকে নিয়ে ‘গঙ্গা যমুনা নাট্য উৎসব’, চলছে আড়াই দশক ধরে। সেই সঙ্গে আন্তঃবিদ্যালয় বাংলা ছোট নাটক প্রতিযোগিতা, তারও এ বার কুড়ি বছর। ২০১৬-তে প্রয়াত কর্ণধারের স্মরণে পরের বছর থেকেই আয়োজিত হচ্ছে অমলেশ চক্রবর্তী স্মৃতি সম্মান ও স্মারক বক্তৃতা। অষ্টম বছরের অনুষ্ঠান আগামী কাল ১ সেপ্টেম্বর রবিবার তপন থিয়েটারে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে। সম্মাননায় ভূষিত হবেন সোহাগ সেন, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, গৌতম হালদার ও কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। স্মারক বক্তৃতায় প্রাক্তন অধ্যাপক ও নাট্য-আলোচক আনন্দ লাল বলবেন ‘মাইকেলের রিজিয়া নাটক আবিষ্কার’ নিয়ে।
পুরব অঙ্গে
পুরব অঙ্গ গায়কির জন্ম গঙ্গা-যমুনা দোআব অঞ্চলে, রাম ও কৃষ্ণকে ছুঁয়ে থাকা জনসংস্কৃতি, উপভাষা, সাহিত্যের মাঝে। ঠুংরি সম্রাজ্ঞী গিরিজা দেবীর ভক্ত বিনোদ কপূরের মনে হয়েছিল, এই গায়কির মাধুর্য রূপ পেতে পারে শুধু বাংলার মাটিতেই: সেই লক্ষ্যেই শুরু হয় ‘পুরব অঙ্গ গায়কি প্রকল্প’ ও উৎসব, বাঙালি কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে এই গায়কির প্রচার-প্রসারে। গিরিজা দেবী, পূর্ণিমা চৌধুরীর মতো শিক্ষাগুরুরা চলে গেছেন, বেনারস ও কলকাতার মঞ্জু সুন্দরম, ডালিয়া রাহুতদের কাঁধে এখন দায়িত্ব। তারই সূত্র ধরে, মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনা ও রূপায়ণে ৩০-৩১ অগস্ট ঠুংরি উৎসব আয়োজন করছে ভারতীয় বিদ্যাভবন ও চৌধুরী হাউস। আজ অনুষ্ঠান চৌধুরী হাউসে দুপুর ২টো থেকে রাত ৯টা; পুরব অঙ্গ গায়কি নিয়ে সঙ্গীতগুরু ও গবেষকদের আলোচনা, পরে সঙ্গীত।
পঞ্চশীল
ভারত ও চিন, দুই দেশের সুসম্পর্ক রক্ষায় ১৯৫৪-র এপ্রিলে গৃহীত হয় ‘পঞ্চশীল নীতি’: অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বে শ্রদ্ধা, অনাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সুবিধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। একুশ শতকে যদিও তা আতশকাচের নীচে, তবু আশাবাদী ডা. দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি। জাপানি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত চিনা সেনা ও জনতার সেবায় ভারতীয় মেডিক্যাল মিশনের পাঁচ চিকিৎসক ১৯৩৮-এর ১ সেপ্টেম্বর চিন যান, তাঁদের অন্যতম ডা. দ্বারকানাথ কোটনিস পরে প্রয়াত হন উত্তর চিনের এক গ্রামে। তাঁর নামাঙ্কিত সংগঠন ১ সেপ্টেম্বর ভারত সভা হল-এ বিকেল ৪টায় স্মরণ করবে তাঁকে, পঞ্চশীল নীতির বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যৎ গুরুত্ব নিয়ে বলবেন অধ্যাপক অমিত দে। রক্তকরবী-র অংশ অভিনয় করবে কোটনিস মাস থিয়েটার গ্রুপ।
স্মৃতি-কণিকা
অণিমা নাম পাল্টে কণিকা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির স্নেহ-ছায়ায় তাঁর সঙ্গীত ও ভাবধারার যথার্থ উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেছিলেন শান্তিনিকেতনের ‘মোহর’। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই তাঁর বাসভবন ‘আনন্দধারা’ও শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে: লতা মঙ্গেশকর রবিশঙ্কর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমজাদ আলি খান সত্যজিৎ রায়, কে আসেননি! গত বছর সেখানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও শতবর্ষ কমিটির উদ্যোগে সূচনা হয় শিল্পীর জন্মশতবর্ষের। প্রদর্শনী, স্মারক বক্তৃতা, বই প্রকাশ-সহ বছরভর নানা অনুষ্ঠানের অবকাশে ‘আনন্দধারা’ বাড়ির দু’টি ঘরে গড়ে উঠেছে ‘কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি অভিলেখ্যাগার ও সংগ্রহশালা’। গত ২৮ অগস্ট উদ্বোধন হল তার। দেখা যাবে শিল্পীর শাড়ি, বটুয়া, পানের বাটা, চশমা, সুগন্ধী, গানের খাতা, বাদ্যযন্ত্র, রেকর্ড, ছবি, চিঠি, মানপত্র— স্মৃতিমাখা অনেক কিছুই (ছবি)। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার নতুন টান তৈরি হল কলকাতার।
ছায়াপুতুল
ভারতে পুতুলনাচ ও পুতুলনাট্যের পরম্পরা সুপ্রাচীন; আজ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, বিনোদনের অন্য জোয়ারে বানভাসি। অথচ এক সময় গোটা উপমহাদেশে লোকশিল্পের এই ধারা শুধু মনোরঞ্জনই করেনি, বহু পরিবারের আর্থিক অবলম্বনও ছিল তা। তবু এই বাংলায় কিছু শিল্পী ও অনুরাগীদের উদ্যোগ ধরে রেখেছে ছায়াপুতুল (ছবি), তারের পুতুল-সহ পুতুলনাচ ও নাট্যের প্রবাহ, যেমন কলকাতার ডলস থিয়েটার। নিয়মিত নানা প্রযোজনার পাশাপাশি এ বার আজ ও আগামী কাল, ৩১ অগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর সেলিমপুর রোডে পাপেটোরিয়ামে তারা আয়োজন করেছে ছায়াপুতুল কর্মশালা। আসছেন জার্মান শিল্পী আন্দ্রিয়া আনা মারিয়া শ্লেমার, দু’দশক ধরে যিনি ‘শ্যাডো থিয়েটার’ নিয়ে গেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে, যাঁর ‘পেপারকাটিং আর্ট ফর্ম’ ছায়াপুতুল শিল্পে যোগ করেছে অন্য মাত্রা। আলো ছায়া শব্দে গল্প শোনাবে তাঁর পুতুলেরা, দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। ছবি সৌজন্য: ডলস থিয়েটার
অচেনা জীবন
প্রবাদে আছে ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন’। আর বইবাজার-ঘনিষ্ঠরা জানেন, আরও কত জন যুক্ত লেখালিখির পরের ধাপ বইয়ের সঙ্গে। যেমন কলকাতার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড, ‘দপ্তরিপাড়া’। গলির মধ্যে, জীর্ণ দশ-বাই-দশ ঘরের এক-একটি দপ্তরিখানায়, গুটিকয়েক মানুষের একযোগে কাজ চলে: ভাঁজাই, সেলাই, বাঁধাই। এ জীবন আমাদের অচেনা ও দূরবর্তী, এই মানুষগুলির জীবন কিন্তু ওতপ্রোত। সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই, বছরের পর বছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন তাঁরা। এঁদের কাজ নিয়েই গত ২৯-৩০ অগস্ট সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ ও ‘নো ইয়োর নেবার’ প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে হয়ে গেল একটি কর্মশালা। ভিডিয়ো, সাক্ষাৎকার, আলোচনা, পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখায় উঠে এল দপ্তরিপাড়ার বহতা ইতিহাস।