প্রীতীশ নন্দী। কলকাতায়, শনিবার। -নিজস্ব চিত্র।
জাতপাতের রাজনীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। জাতপাতের রাজনীতির ক্ষতি করার ক্ষমতা কম। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করোনাভাইরাসের মতো। শক্তিশালী তো বটেই। তার সংক্রমণটা হয় খুব দ্রুত। তা অপ্রতিরোধ্যও।
বললেন প্রীতীশ নন্দী। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য। ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে, শনিবার।
জাতপাতের রাজনীতি তো ভারতে নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছে। চলছে, চলবেও। স্পষ্টবাক বলে সুপরিচিত ও ‘নিন্দিত’ (!) প্রীতীশ কিন্তু মনে করেন, তেমন একটা সর্বগ্রাসী ক্ষমতা নেই জাতপাতের রাজনীতির।
শুনে খটকা লাগতে পারে। কারণ, শুধুই গোবলয়ে নয়, দেশের প্রায় সর্বত্রই জাতপাতের রাজনীতি করে টিকে থাকতে দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলিকে। ভেলা ভাসাতে হয় ভোট বৈতরণী পেরতে।
জাতপাতের রাজনীতি দুর্বল...
প্রীতীশ মনে করেন, ক্ষমতার নিরিখে জাতপাতের রাজনীতি দুর্বলই। কারণ, এ দেশে বিভিন্ন জাতের (কাস্ট) মধ্যেও যথেষ্ট বিভাজন রয়েছে। সাব-কাস্ট রয়েছে। জাতপাত-নির্ভর আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে ওঠায় সেই বিভাজনরেখা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ক্রমশ। বিভাজন থেকেই বিরোধের সূত্রপাত হয়। ‘কলিশন’ (সংঘর্ষ) হয়। তাই জাতপাতের রাজনীতি কিছুতেই শক্তপোক্ত, মজবুত হয়ে উঠতে পারে না। ভিতরে ভিতরে তা ফোঁপরা হয়ে যায়। সাব-কাস্টগুলির রেষারেষি, ধাক্কাধাক্কিতে। এটা অতীতে বহু বার প্রমাণিত হয়েছে। আগামী দিনে আরও হবে।
দিল্লির শাহিনবাগের প্রতিবাদ। ছবি- এপি।
প্রীতীশের মতে, এর ফলে, জাতপাতের ভোটের শতাংশের হিসাবটা এলোমেলে হয়ে যায়। কমে, বাড়ে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে যেটা একেবারেই হয় না। কারণ, কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই বিভাজনরেখা থাকে না বললেই চলে। ধর্মের নামে সকলকে একই দিকে ছোটানো যায়। একবগ্গা। যুক্তি-তক্কোর পরোয়া না করে। খ্রিস্টানে বড়জোর দু’টো ভাগ। ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট। ইসলামেও তাই। শিয়া ও সুন্নি। হিন্দুদের মধ্যে সেই বিভাজনরেখাটা যদিও বা কিছু থেকে থাকে, রেষারেষি, মারামারি, কাটাকাটি নেই অন্তত।
হিন্দুত্বের ছাতাটা ক্রমশই বড় হচ্ছে!
হিন্দু বলে বোঝাতে হিন্দুত্বের ছাতাটাও কি বড় করা না হচ্ছে না ইচ্ছাকৃত ভাবে? উত্তরোত্তর।
প্রীতীশ মনে করেন, সেটা খুবই দৃষ্টিকটূ ভাবে হচ্ছে এখন ভারতে। বিভিন্ন তফশিলি জাতিকেও হিন্দু বলে চালানো হচ্ছে। শিখ, বৌদ্ধ, জৈনদেরও আনা হচ্ছে হিন্দু ছাতার তলায়! এখনও ছাতার বাইরে থাকা তফশিলি জাতিগুলিকে সেই ছাতার তলায় আনারও চেষ্টা চলছে। অথচ, তফশিলি জাতির মানুষকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে নিগৃহীত, অত্যাচারিত হতে হচ্ছে।
হিন্দুইজমের ‘ওয়েপনাইজ্ড ভার্সান’ মোদীর হিন্দুত্ব!
প্রীতীশের কথায়, ‘‘ভারতে হিন্দুত্ব বলে এখন যেটাকে চালানো হচ্ছে, তার সঙ্গে হিন্দুইজম বা হিন্দু ধর্মের কোনও মিল তো দূরের কথা, যোগাযোগও নেই বিন্দুমাত্র। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের হিন্দুত্ব আসলে ওয়েপনাইজ্ড ভার্সান অফ হিন্দুইজম। আর সেটাকে কার্যকর করতে গিয়ে রাজনীতির দেদার দুর্বৃত্তায়ন (‘লুম্পেনাইজেশন’) হচ্ছে। আর তাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে (‘লেজিটিমাইজ্ড’)। এটা হাস্যকর। এখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কাটাকাটি, খুনোখুনির যত ঘটনা ঘটে চলেছে, দেশভাগের ঠিক পরেও সেই ভয়াবহতা ছিল না। থাকলে মুসলিমরা কবেই ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেত! বরং এ দেশে মুসলিমরা স্বাধীনতার পর রাজখাতিরই পেয়েছেন। এখনও পান, সেটা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের পছন্দ না-ও হতে পারে।’’
আরও পড়ুন- ‘শিল্পী, বিজ্ঞানী, অধ্যাপকরা মুখ ফেরাচ্ছেন বিজেপি থেকে’, আড্ডায় একমত তিন নন্দী
আরও পড়ুন- সিএএ নিয়ে বইমেলার অশান্তি আঁচ ছড়াল বিধাননগর থেকে যাদবপুর
প্রীতীশ মনে করেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে নামলে পিছনে সমর্থনের একটা সুন্দর ইজিচেয়ার থাকে। যেটা মট করে ভেঙে যায় না। তবে এর অত্যন্ত বিপজ্জনক দিকটা হল, এতে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্রেতাবাজারটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। তার ফলে, বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেপেলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তাঁর কথায়, ‘‘সেটা হতে শুরুও করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়া তো দূরের কথা, বরং কমছে।’’
বিকল্প জোট মানেই তো ঘোঁট! তা হলে?
বিকল্পের কথা ভাবতে বসলেই তো ভোটারদের স্মৃতিতে আসে কেন্দ্রে কোনও একটা দুর্বল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। যার মাথায় থাকবে কংগ্রেস। কিন্তু তাকে প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে থাকতে হবে জোটের (‘কোয়ালিশন’) শরিক দলগুলির উপর। যাদের অনেকগুলিই আঞ্চলিক। তাদের দর কষাকষির ফলে জোট সরকারটা দুর্বল হয়ে থাকবে সব সময়। আজ এক জন প্রধানমন্ত্রী তো কাল অন্য জন। ‘আয়ারাম গয়ারাম’ সরকার!
সিএএ বিরোধী আন্দোলন। পঞ্জাবে। ছবি-পিটিআই
প্রীতীশ মনে করেন, সেটাই আদর্শ সরকার। দুর্বল সরকারই প্রয়োজন। তাতে সেই সরকারকে ক্ষমতায় থাকার প্রলোভনেও কিছু সঠিক কাজ করতে হবে। আমজনতার দাবিদাওয়াগুলি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেই সরকার কোনও মজবুত, শক্তপোক্ত সরকারের চেয়ে বেশি উৎসাহী হবে। কেন্দ্রে মজবুত সরকার মানেই, বিরোধীদের শক্তি কম। ফলে, তাদের গলার জোরটা কম। হিটলারের জার্মানি বা স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে যা হয়েছিল, কেন্দ্রে মজবুত শক্তপোক্ত সরকার দিনের পর দিন ক্ষমতায় থাকলে সেটাই হবে।
প্রয়োজন ‘স্ট্রং সিটিজেনরি’
নাগরিকদের অধিকারবোধটাকেও খুব শক্তপোক্ত করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন প্রীতীশ। যাতে তাঁরা মনে করেন, তাঁদের একটা ভোটই সরকারটাকে উল্টে দিতে পারে। তাঁদের পছন্দের সরকারটাকে ক্ষমতার কুর্সিতে বসিয়ে দিতে পারে। এটাকেই বলে, ‘স্ট্রং সিটিজেনরি’। এটা গড়ে তোলা সম্ভব হলেই মানুষ আরও বেশি সংখ্যায় বুথে যাবেন ভোট দিতে। নেগেটিভ ভোটিং করবেন না হতাশায়। বুথে গিয়ে ‘হ্যাঁ-কে ‘হ্যাঁ’, ‘না’কে ‘না’ বলে আসার সাহস পাবেন, সেই আশায় বুক বাঁধতে পারবেন।
আড্ডা শুরু করলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী (পিছনে)। -নিজস্ব চিত্র।
কংগ্রেসকে আরও বদলাতে হবে...
প্রীতীশের বক্তব্য, এই পরিবর্তনগুলির জন্য কংগ্রেসকে আরও বদলাতে হবে আগামী দিনে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সেই বদলটা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কারণ, কংগ্রেসই দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। তার দীর্ঘ দিনের জনভিত্তি রয়েছে। ফলে, নিজেকে বদলে নেওয়ার দায়িত্বটা তারই সবচেয়ে বেশি। কংগ্রেসকে রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে হবে। সেটা বুঝে যেমন মহারাষ্ট্রে এ বার দীর্ঘ দিনের শত্রু শিবসেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোট সরকার গড়ল কংগ্রেস। এমন ভাবে কংগ্রেসকে অনেক রাজ্যে অনেক আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকারে আসতে হবে। একই ভাবে কেন্দ্রেও সরকার গঠনের লক্ষ্যে দৃঢ়বদ্ধ হতে হবে।
কংগ্রেসকে বংশতন্ত্র থেকে বের করাটাই মোদীর সাফল্য!
প্রীতীশ মনে করেন, মোদী জমানার সবচেয়ে বড় সাফল্য, তিনি ও অমিত শাহ কংগ্রেসকে বংশতন্ত্রের সুদীর্ঘ পরম্পরা থেকে কিছুটা হলেও বের করে আনতে পেরেছেন। গাঁধী পরিবারকে লাগাতার আক্রমণ করে। তাই নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে দেখা গিয়েছে রাহুল গাঁধীকে। পরবর্তী সভাপতি নিয়ে গাঁধী পরিবারের বাইরে কয়েকটি নাম নিয়েও চর্চা চলেছে দলের বাইরে তো বটেই, ভিতরেও! এটা কংগ্রেসে বহু দিন ভাবা যেত না।
‘‘মোদী, অমিত শাহ যদি সত্যিই কিছু কাজের কাজ করে থাকেন, তা হলে সেটা এই কাজটাই’’, বলছেন প্রীতীশ।