WB assembly election 2021

প্রতিবাদী জীবন আরও নরক নেট-লাঞ্ছনায়

ভোটের আগে ধর্ম-জিগিরে গুলিয়ে যাচ্ছে নাগরিকদের প্রকৃত দাবিদাওয়া। কদর্য হুমকিতে কোণঠাসা প্রতিবাদী স্বর।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২১ ০২:১১
Share:

প্রতীকী ছবি।

নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়কার কথা। তৎকালীন শাসক দলের নেতা প্রতিবাদরত সমাজকর্মীকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ‘লাইফ হেল’ করার হুমকি দিয়েছিলেন। সেই পটভূমিতে লেখা হয় শঙ্খ ঘোষের কবিতা।

Advertisement

‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে / যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন, দিয়েছি নরক করে’!

রাজ্যে বা দেশে জমানা বদলের পরেও এ কবিতা বার বার প্রাসঙ্গিক বলে উদ্ধৃত হয়েছে। এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেও কামদুনি, কাটোয়া, কলকাতায় যে কোনও প্রতিবাদী স্বরকেই একদা ‘মাওবাদী’, ‘সিপিএম’ বলে দাগিয়ে দেওয়া দস্তুর হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ দূরে থাক, সোশ্যাল মিডিয়ায় চুটকি শেয়ার করে পুলিশি হেনস্থা, হাজতবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে এক অধ্যাপকের। কিন্তু নেট-রাজ্যের আজকের ট্রোল-বাহিনীর হামলায় পুলিশ-প্রশাসনেরও সাহায্য লাগে না।

Advertisement

শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল, অন্যে কবে না কথা/ বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে, সেটাই স্বাভাবিকতা’! অভিজ্ঞতা বলছে, এখন আর দাপিয়ে বেড়াতে রাজ্য শাসনের ক্ষমতারও দরকার পড়ে না। সংগঠিত ট্রোল-বাহিনী এবং অন্ধবিশ্বাস সর্বস্ব ভক্তদের সৌজন্যে জীবন নরক করার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও সর্বাত্মক। প্রতিবাদীকে হেনস্থার এই কৌশলের অভিনবত্বের কথাই বলছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মৈত্রেয়ী চৌধুরী। তাঁর কথায়, “এটা কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক তর্ক নয়। অপছন্দের মানুষটিকে কয়েকটি বাঁধাধরা দোষ দিয়ে তিনি হিন্দু-বিরোধী, দেশ-বিরোধী, মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট তকমা দিয়ে নিশানা করা, তাঁর কোনও কথাই না-শোনা এবং তিনি মহিলা হলে কুৎসিত ভাষায় চরিত্রহনন, হুমকি বার বার দেখা যাচ্ছে।” অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য মনে করাচ্ছেন, বিজেপি-র প্রয়াত বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও এই হিন্দুত্ববাদী লেঠেল-বাহিনীর কদর্য নেট-লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পাননি।

এ যাত্রায় অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তকে টিভি চ্যানেলে এক বন্ধু ও চিত্র পরিচালক-গায়কের উদ্দেশে করা গোমাংস রান্না বিষয়ক একটি মন্তব্যের জন্য কোণঠাসা করা হয়েছে। আর বিজেপি-ঘনিষ্ঠ তথাগত রায়ের সঙ্গে তর্কের পরে সায়নী ঘোষের টুইটার হ্যান্ডেলের ছ’বছর আগের একটি টুইট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সায়নী অবশ্য টুইটটি অন্য কারও অপকীর্তি এবং তাঁর নিজের কাছেও আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। পুরাণ-শাস্ত্রবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর চোখেও শিবঠাকুরকে নিয়ে নেটে চর্চিত মিমটি অপছন্দের। তবে তাঁর বক্তব্য, হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যেই দেবদেবীদের নিয়ে নানা রকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি, আদিরসাত্মক কথারও চল রয়েছে। খারাপ লাগলে যা উপেক্ষা করাই যায়। তাঁর কথায়, “প্রভাবশালী রাজনীতির লোকজনও লেঠেল-বাহিনীর ভূমিকায় নেমে যা করছেন, সেটাই অসহিষ্ণুতা। এঁরা হিন্দু শাস্ত্র আদৌ পড়েছেন কি? কুতর্ক না থামিয়ে উল্টে আপত্তিকর ছবি বার বার প্রচার করে এঁরাই ধুয়ো দিয়ে চলেছেন।”

দু’জনের আলগা মন্তব্যকে নিয়ে কদর্য আক্রমণ ভয়ঙ্কর প্রবণতা বলে নিন্দায় সরব জয় গোস্বামীও। আর ধর্ম প্রসঙ্গে অতি স্পর্শকাতরতার এই প্রবণতার মধ্যে মৈত্রেয়ী পাকিস্তান, বাংলাদেশের ছায়া দেখছেন। তাঁর কথায়, “হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে বার বার টেনে এনে আসলে দ্বিজাতিতত্ত্বকেই মান্যতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভারত তো ‘হিন্দু পাকিস্তান’ নয়। বরং পাকিস্তানেই ইদানীং
পরমত সহিষ্ণুতার কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।”

তবে অনেকেরই মত, সমাজমাধ্যমের আলোচনা বা টুকরো মন্তব্যে এখন অন্তরঙ্গ এবং প্রকাশ্যের সীমারেখা হারিয়ে যাচ্ছে। আর তার সুযোগ নিচ্ছে নানা শিবিরের ট্রোল-বাহিনী, যাদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীদের পাল্লা বেশ ভারী। সায়নীর সঙ্গে তর্কের সময়ে কী ভাবে ছ’বছর আগের টুইট প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল? তথাগতবাবুর কথায়, “আমি ও সব টেকনিক্যাল ব্যাপার বুঝি না। উনি নিজেই কিছু করে থাকবেন।” পুরনো মন্তব্যের সত্যি-মিথ্যে স্ক্রিনশট ব্যবহার করে ট্রোল-বাহিনীর হেনস্থার কৌশল অবশ্য ইদানীং বহুল প্রচলিত। সৌরীনবাবুর আক্ষেপ, “সুপরিকল্পিত ভাবে ধর্মের নামে কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে ভোট-বাজারে প্রাসঙ্গিক করে তোলার খেলা চলছে। যা অনেকের ভাবাবেগ উস্কে দেবে।” এবং এই কৌশল কার্যকর করার লক্ষ্যে সবার উপরে স্ক্রিনশট সত্য, তাহার উপরে নাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement