গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রের মৃত্যু ঘিরে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। সোমবার কলকাতার রাজপথে মিছিলে পা মেলাল শাসক এবং বিরোধী— দু’পক্ষই। দুপুরে মিছিল করল শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। বিকেলে মিছিলে হাঁটলেন বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের কর্মী-সমর্থকেরা। র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সরব হল দু’পক্ষই। বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় সোমবারই প্রথম বার মুখ খুললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেহালার ম্যান্টনে দলীয় কর্মসূচিতে মমতা বলেন, ‘‘যারা ছেলেটাকে উপর থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তারা সব মার্ক্সবাদী। এরা কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেস। ওখানে কিছু আগমার্কা সিপিএম আছে। তারা ছেলেটার জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়েছিল।’’ মমতার ‘মার্ক্সবাদী’ মন্তব্যের পাল্টা সরব হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘যারা ছেলেটাকে মেরেছে তাদের গুরুদের মমতা জঙ্গলমহলে পাঠিয়েছিলেন সিপিএমকে খুন করার জন্য। ওই মার্ক্সবাদীদের উনি নিজের দলেও ঢুকিয়েছিলেন, মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আর এখন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’’
অন্য দিকে, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় হইচই পড়ে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। উঠেছে র্যাগিংয়ের অভিযোগ। এর মধ্যেই র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ডাকা বৈঠক ঘিরে সোমবার উত্তেজনা ছড়াল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এসএফআই এবং ডব্লিউটিআইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনায় এসএফআইয়ের এক নেতা জখম হয়েছেন বলে দাবি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
যাদবপুর এখন ‘আতঙ্কপুর’
যাদবপুরকে ‘আতঙ্কপুর’ বলে কটাক্ষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার বেহালার ম্যান্টনে দলীয় কর্মসূচিতে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় মুখ খোলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে পুলিশ ঢুকতে দেয় না। সিসিটিভি লাগাতে দেয় না। র্যাগিং করে। যাদবপুর এখন আতঙ্কপুর। অনেক জায়গায় গেলেও, যাদবপুরে আমি যেতে চাই না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যাদবপুরের ওই ছেলেটির হাতে একটা মাদুলি ছিল। ওরা বলেছিল সেটা খুলতে হবে। যেন জমিদারি। ওটা যেন ওদের রেড ফোর্ট! যারা ছেলেটাকে উপর থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তারা সব মার্ক্সবাদী। এরা কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেস।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নিজের ধারণার কথাও বলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘ওরা (যাদবপুরের পড়ুয়ারা) হয়তো পড়াশোনায় ভাল। তবে পড়াশোনায় ভাল হলেই সব হয় না।’’ সেই সঙ্গে মমতা জানান, যাদবপুরের সবাই যে খারাপ, তা তিনি মনে করেন না।
যাদবপুরকাণ্ডে জোড়া মিছিল
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় উত্তাল কলকাতার রাজপথ। সোমবার জোড়া মিছিলে হাঁটল শহর। দুপুরে ঢাকুরিয়া দক্ষিণাপণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর গেট পর্যন্ত মিছিল করে শাসকদলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)। বিকেলে যাদবপুর থানা থেকে এইট-বি পর্যন্ত মিছিল করে বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই। শাসক এবং বিরোধী— দু’পক্ষই ছাত্রমৃত্যুর তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছে। একই সঙ্গে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছে তারা।
যাদবপুরে উত্তেজনা
দেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। উঠেছে র্যাগিংয়ের অভিযোগ। এই আবহে সোমবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে র্যাগিং নিয়ে বৈঠকে উত্তেজনা ছড়াল। এসএফআই এবং ডব্লিউটিআই-এর মধ্যে সংঘর্ষ বাধল। এসএফআই-এর এক কর্মী জখম হন বলে দাবি। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এসএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি প্রতীক-উর রহমান বলেন, ‘‘র্যাগিং নামক বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চাইছে ডব্লিউটিআই-র মতো সংগঠনগুলি। ঘটনা ধামাচাপা দিতেই ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতি দিন ক্যাম্পাসের মধ্যে গণতন্ত্র হরণ করা হচ্ছে। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। এত বড় ঘটনা ঘটল, মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করলেও বিবৃতি দিলেন না। শিক্ষামন্ত্রীর কোনও বক্তব্য নেই।’’ যদিও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডব্লিউটিআই-এর পক্ষ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
যাদবপুরকে শো-কজ়
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে সোমবার শো-কজ় করল রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশন। সুপ্রিম কোর্ট র্যাগিং সংক্রান্ত যে নির্দেশ দিয়েছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তা অমান্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ। র্যাগিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর নির্দেশিকাও মানা হয়নি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাধে র্যাগিং চলেছে। প্রথম বর্ষের নতুন ছাত্রছাত্রীরা র্যাগিংয়ের কারণে আতঙ্কিত। কেন নিয়ম মানা হল না? দু’দিনের মধ্যে যাদবপুর কর্তৃপক্ষকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিবৃতি দিয়ে কমিশন জানিয়েছে, যে ছাত্রছাত্রীরা র্যাগিং-বিরোধী নিয়মকানুন এবং নির্দেশিকা মানেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ফলেই প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার মর্মান্তিক এই মৃত্যু। কেন কোনও পদক্ষেপ করলেন না কর্তৃপক্ষ? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
হাই কোর্টে মামলা
র্যাগিংয়ের কারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। সোমবার যাদবপুরকাণ্ডের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে র্যাগিংয়ের বিষয়ে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরন্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আইনজীবী সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছে আদালত। চলতি সপ্তাহেই মামলাটির শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। র্যাগিং-বিরোধী কমিটির নির্দেশিকার বাস্তবায়ন চেয়ে সোমবার মামলা দায়ের করা হয়েছে হাই কোর্টে। মামলাকারীর আবেদন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে ইউজিসি ওই কমিটির নির্দেশিকা মেনে চলার ব্যবস্থা করে, তা নিশ্চিত করা হোক। তবেই কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের দাপট কমবে।
ইউজিসিকে রিপোর্ট
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি)-কে রিপোর্ট দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই রিপোর্ট ইউজিসিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে, বুধবারের ঘটনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত চার দিনে কী কী পদক্ষেপ করেছেন তাঁরা। রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জানানো হয়েছে, বুধবারের ঘটনার পরেই ওই ছাত্রকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। তাঁর চিকিৎসারও বন্দোবস্ত করেন কর্তৃপক্ষ। এর পর তাঁরা পুলিশে এফআইআর দায়ের করেন। কী ভাবে ওই ছাত্র হস্টেলের তিন তলার বারান্দা থেকে পড়ে গেলেন, তা জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইউজিসিকে দেওয়া রিপোর্টে সেই কমিটির কথাও জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় আরও জানিয়েছে, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর হস্টেল থেকে নতুন ছাত্রদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রাখা হয়েছে নতুন একটি হস্টেলে। ছাত্রেরা যাতে আতঙ্কিত না হয়ে পড়েন, তার জন্য তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বলেছেন কর্তৃপক্ষ। তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে প্রত্যেক বিভাগের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক জন করে পরামর্শদাতা (মেন্টর) নিয়োগ করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের যে কোনও রকম সমস্যার কথা ওই মেন্টরকেই জানানোর কথা। সেই মেন্টরদের নামের তালিকাও ইউজিসিকে পাঠিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আগামী বুধবার যাদবপুরের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ইউজিসির একটি প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে। সেই দলের সদস্যেরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং তদন্তের অগ্রগতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন।
মানবাধিকার কমিশনের নোটিস
যাদবপুরকাণ্ডে সোমবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে নোটিস পাঠাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। নোটিসে কমিশন জানিয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনার আগে ডিন অফ স্টুডেন্টস-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মৃত ছাত্রের সহ-আবাসিকেরা। কিন্তু তাঁদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ, সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যে উঠে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ এবং দায়িত্বে অবহেলার কথা। যেখানে এক জন ছাত্রের র্যাগিংয়ের আতঙ্কে মৃত্যু হয়েছে। নোটিসে লেখা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের এই সমস্ত খবর যদি সত্যি হয়, তাতে পরিষ্কার যে ছাত্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছে কমিশন। সেই রিপোর্টে ইউজিসি-র নির্দেশ অনুযায়ী র্যাগিং প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ করতে প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক ব্যর্থতার কারণ এবং র্যাগিংয়ে প্ররোচনাকারী, জড়িত-সহ অপরাধীদের শাস্তির জন্য নেওয়া বা প্রস্তাবিত পদক্ষেপের কথাও অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। রাজ্য জুড়ে ছাত্র সম্প্রদায় এবং শিক্ষক সমিতিগুলির মধ্যে র্যাগিং সম্পর্কে সচেতনতা মূলক প্রচার করার জন্য রাজ্য সরকার কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে তারও উল্লেখ থাকতে হবে ওই রিপোর্টে।
রেজিস্ট্রারের কান্না
কেঁদে ফেললেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু। যাদবপুরে এই মুহূর্তে কোনও উপাচার্য না থাকায় রেজিস্ট্রারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই সোমবার তিনি ক্যাম্পাসে আসতেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এত দিন কোথায় ছিলেন? ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না কেন? সেই সব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েই কেঁদে ফেলেন রেজিস্ট্রার। ঘটনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রারকে দেখা যায়নি। ছাত্রমৃত্যুর চার দিন পর সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি অসুস্থ ছিলাম। তাই মঙ্গলবারই মেডিক্যাল লিভ নিয়েছিলাম। চিকিৎসকের কথায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম বলেই ফোন বন্ধ ছিল।’’ এর পর স্নেহমঞ্জু দৃশ্যত কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘‘আমি মর্মাহত। কোনও মায়ের কোল খালি হোক চাই না।’’ কিন্তু যেখানে সংবাদমাধ্যমে যাদবপুর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে তিনি কি বিষয়টি জানতেও পারেননি? জবাবে স্নেহমঞ্জু বলেন, ‘‘হাঁটুর ব্যথা। তাই আসতে পারিনি। আজও কষ্ট করেই আসতে হয়েছে। তা ছাড়া আমার হাই প্রেশার। এই বিষয়গুলো একদম নিতে পারি না। অভ্যন্তরীণ কমিটিও তদন্ত করছে। পুলিশও তদন্ত করছে। আমি চাই, দোষীরা শাস্তি পাক।’’ এই ঘটনায় তিনি আরও বলেছেন, ‘‘উপাচার্য থাকলে এ ভাবে সবটা আমাদের উপর চলে আসত না।’’